শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

নুন চিনি জলেই জীবনদান


সুপর্ণা রায়, চিন্তন নিউজ, ২৩ জুন: ওপারে মু্ক্তি যুদ্ধ আর এপারে উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত। ১৯৭১ সাল। শিকড় ছেঁড়া লাখ লাখ মানুষ অস্থায়ী শিবিরে । আক্রান্ত হতে লাগল কলেরা, ডাইরিয়াতে। বনগাঁ সীমান্ত, পথে ঘাটে মানুষের লাশ। শিবির গুলোতে বমি দাস্তের স্রোত। ভয়ংকর সেই মৃত্যুমিছিল। ত্রাতা হয়ে এলেন এক বাঙালি চিকিৎসক, নাম দিলীপ মহলানবিশ। আক্রান্তদের মধ্যে প্রয়োগ করলেন ওআরএস। সাড়া পেলেন ম্যাজিক এর মতো। দ্রুত নামিয়ে আনলেন মৃত্যুর হার।

১৯৭১ সালের ২৪ শে জুন থেকে ৩০ শে আগষ্ট কলেরার সাথে লড়াই চালিয়ে গোটা বিশ্বে পৌঁছে দিলেন ওআরএস প্রয়োগের ইতিহাসকে। কলেরা চিকিৎসায় রিহাইড্রেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সব রোগে রক্ত থেকে নুন ও জল বেরিয়ে গিয়ে দ্রুত রক্তচাপ নামিয়ে দেয়। আগে এর প্রয়োগ ছিল ইন্ট্রাভেনাস, শিরার মধ্যে সূঁচ ফুটিয়ে স্যালাইন দেওয়া। পানীয়ের মাধ্যমে তা চালু করার বিষয়ে গবেষনা শুরু হয় গত শতকের চল্লিশের দশকে। ১৯৬৪ সালে মার্কিন চিকিৎসক বব ফিলিপস দুজন কলেরা রোগীর উপর ওআরএস প্রয়োগ করেন। কিন্তু এত মানুষের মধ্যে এর প্রয়োগ প্রথম ঘটল এ বঙ্গে। ৮৫ বছর বয়সেও সেই স্মৃতি অমলিন দিলীপ বাবুর।

সেদিনের বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি বললেন “ক্যাম্প ভর্তি রোগী, সর্বত্র নোংরা। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে সমানে ইন্ট্রাভেনাস পুশ করে যাচ্ছি। এদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রুগীর সংখ্যা। এমন একটা সময় এল যখন সেকেন্ড পলিসি নিতেই হল। যদি বাঁচানো যায় একজনকেও। পানীয় হিসাবে প্রয়োগ করলাম সলিউশান। অনেকে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম।” এক লিটার জলে ২২ গ্রাম চিনি, ৩.৫ গ্রাম নুন আর ২.৫ গ্রাম বেকিং সোডা। তৈরী হল মিশ্রন। সাড়া পেলেন অচিরেই। মুমূর্ষু রোগীরা চোখ মেলে তাকাল।

১৮৫৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে সেখানেই শিশু বিভাগে ইন্টার্নশিপ শুরু করেন। ১৯৬০ সালে লন্ডনে চালু হল ন্যাশানাল হেলথ সার্ভিস। প্রচুর ডাক্তারের চাহিদা তখন। আবেদন করলেন, সুযোগও এল। ডিসিএইচ করলেন, এমআরসিপি করলেন এডিনবরা থেকে। কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফর চিল্ড্রেন-এ যোগ দিলেন । তখন এই তরুন ডাক্তার এর বয়স ২৮ বছর।

এই সময় ভারতে একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল বেলেঘাটার আই.ডি হসপিটাল, যেখানে কলেরার চিকিৎসা হত। ১৯৬৪ তে দেশে ফিরে সেখানে যোগ দিলেন। এখানেই শুরু হল ওআরএস নিয়ে গবেষণা। গবেষনাপত্র হাতে পাওয়ার আগেই ১৯৭১ সালে ওই ভয়ংকর ঘটনা। জনা আটেক পরিচিত ছেলে নিয়ে ছুটলেন বনগাঁ সীমান্তে। সঙ্গীরা সাধারন মানুষ।দু’মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে এল সাফল্য। বিশদ তথ্য দিয়ে পেপার লিখলেন। ১৯৭৩ সালে জার্নালে প্রকাশিত হল তা। বিখ্যাত “ল্যান্সেট” পত্রিকা স্বীকৃতি দিল সেই প্রকাশনাকে। বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল এই খবর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ডেকে নিল তাকে।

১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর প্রথম পর্ব পর্যন্ত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ডায়রিয়া ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম এর মেডিক্যাল অফিসার নিযুক্ত হলেন। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করার সুবাদে পেয়েছেন নানা পুরষ্কার।

১৯৯১ সালে সল্টলেকের বাড়িতে তৈরী করেন “সোসাইটি ফর এপ্লায়েড স্টাডিজ”। দিলীপ বাবুর আফসোস “ডাক্তারি পাশ করা ছেলেমেয়েদের হাতে কলমে গবষনা, ফিল্ডওয়ার্ক শেখানোর জন্য এই উদ্যোগ। অথচ সরকারি সহযোগীতা ও ছাত্র ছাত্রী এই দুইয়ের অভাবে ধুকছে আমার সোসাইটি।”


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।