রাজ্য

এন বি এ: আট দশকের পথ চলা


অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী: চিন্তন নিউজ:২৯শে জুলাই:- কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসকে বাঁদিকে রেখে বঙ্কিম চ্যাটারজি স্ট্রিট ধরে কিছুটা এগিয়ে রাস্তার ধারে একটি দোকান। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। ঠিকানা ১২ এ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট। সংস্কৃত কলেজের বিপরীতে এই দোকান বইপাগল মানুষের কাছে অতি পরিচিত নাম। এ বছরের ২৬শে জুন ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড ৮১বছর পূর্ণ করেছে।

এটি শুধু একটি বইয়ের দোকান নয় ,বিশেষত বাংলা ভাষায় মার্কসবাদী ও অন্যান্য প্রগতিশীল বইপত্র প্রকাশ ও বিক্রির একটি প্রথম সারির সংস্থা,যা এন বি এ নামে বেশি পরিচিত।

রুশদেশে নভেম্বর বিপ্লবের বার্তা দুনিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। গত শতাব্দীর বিশ,ত্রিশের দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের মত নিবিড় ছিল না, তবু সেই বার্তা এত জোরালো ছিল যে এদেশে তা পৌঁছাতে বিলম্ব হয়নি। যদিও ব্রিটিশ সরকারের কড়া নজর ছিল যাতে কোনভাবে বলশেভিকবাদ ভারতের মাটি স্পর্শ করতে না পারে।

সেই গোড়াপত্তনের দিনগুলি সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট ভাষায় লিখে গেছেন এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুজাফফর আহমদ। তিনি” ন্যাশনাল এর ২৫ বছর “শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন” কোন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি যখন স্থাপিত হয়েছে তখন তার সঙ্গে সঙ্গে একটি পুস্তক বিক্রয় প্রকাশনা ভবনের কথা উঠেছে । কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক ভিত্তি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত । কমিউনিস্টদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল ও সাময়িক সাহিত্য পড়তে হয় এবং অন্যদেরও তা পড়াতে হয়।

এইভাবে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচারিত ও প্রসারিত হয়। কাজেই নিজেদের সাহিত্য পরিবেশনের ব্যবস্থা কমিউনিস্টদের একান্ত ভাবে চাই। ভারতবর্ষেও উনিশ ও বিশএর দশকে আমাদের একটি পুস্তকের দোকান খোলার কথা যে ওঠেনি তা নয় ।কিন্তু অবস্থা আমাদের পক্ষে ছিল না ।সংখ্যা য় আমরা কম হলেও আমাদের সাহিত্য পরিবেশনের দোকান খুলতে পারলে বাইরের লোকেরাও তা কিনতেন ।তবে দোকান খোলার জন্য যে টাকার দরকার ছিল তা জোগাড় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না ।বিদেশ থেকে সাহিত্য আমদানির পক্ষে বাধা ছিল খুব বড়। সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের উপর পুলিশের জুলুম শুরু হয়েছিল সেই শুরুর দিন গুলি থেকেই।”

যাইহোক অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১৯৩৯ সালের মুজাফফর আহমদ, রেবতী বর্মণ ও সুরেন্দ্রনাথ দত্তের মিলিত উদ্যোগে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজাফফর আহমদ লিখছেন “আমাদের মূলধন ছিল কমিউনিস্ট পার্টির শুভেচ্ছা কমরেড সুরেন্দ্রনাথ দত্তের শ্রম,আর কমরেড রেবতী বর্মনের জোগাড় করা দুইশত টাকা।”

প্রথম যে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি হল রেবতী বর্মনের লেখা ১ । সোসাইটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট (Society and development) ২ । মার্কসিস্ট ভিউ অফ ক্যাপিটাল (Marxist view of capital) ৩। সমাজের বিকাশ।

১৯৪৫ সালে এর নিজস্ব প্রকাশনার কাজে বিশেষ জোর দেওয়া শুরু হয়। বিনয় ঘোষ, অনিল কাঞ্জিলাল সুশীল জানা প্রমুখ বিশিষ্ট লেখক এই সময় এ ন বিএ প্রকাশনা ও সম্পাদনা বিভাগের যোগ দিয়েছিলেন। এর আগেই ১৯৪৪ সালে লন্ডনের লরেন্স এন্ড উইশর্ট প্রকাশনা সংস্থা এবং মস্কো থেকে বই আমদানি শুরু হয়। এর কিছুদিন পরে এন বিএর সম্পাদনা, অনুবাদের কাছে যুক্ত হন গোপাল হালদার চিন্মোহন সেহানবীশ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় , সুভাষ মুখোপাধ্যায় , পুষ্পময়ী বসু , সুনীলচট্টোপাধ্যায় ,সোমনাথ লাহিড়ী দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় প্রমূখ । ষাটের দশকে কিছুদিনের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন লেখক অমল দাশগুপ্ত, কবি বিনয় মজুমদার প্রমূখ। বিভিন্ন পর্বে এ ন বি এর বইয়ে প্রচ্ছদ অংকন অথবা সাধারণ অলংকরণ করেছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায় খালেদ চৌধুরী, পূর্ণেন্দু পত্রী ,শংকর দাশগুপ্ত গণেশ বসু ,ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , যুধাজিৎ সেনগুপ্ত, শিব শংকর ভট্টাচার্য্য ,শ্যামল জানা তমাল ভট্টাচার্য প্রমূখ শিল্পী।
এদেশে কমিউনিস্ট পার্টিতে যে ভাঙন ধরে তার আঁচ এসে পরে এন বি এএর উপর। যদিও এনবিএ বরাবর বৃহত্তর প্রগতিশীল পাঠকদের আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।

সত্তরের দশকে সন্ত্রাসের দিনগুলিতে এন এন বি এর দোকানের উপর হামলা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এইসব প্রতিকূল দিনগুলিতে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সুনীল বসু, সলিল গাঙ্গুলী ,নন্দলাল চ্যাটার্জী ,শ্যামসুন্দর দে র মত মানুষজন।সেইসঙ্গে সংস্থার সাধারণ কর্মীদের বিপুল আত্মত্যাগ এ প্রতিষ্ঠানকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি পেরিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
দীর্ঘদিন ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত বই এবং চীন দেশ থেকে প্রকাশিত বই এনবি এ কাউন্টার থেকে বিক্রি হতো। বড় অংশের পাঠক এই বইয়ের আকর্ষনে আসতেন।কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর সে দেশ থেকে বই আসা বন্ধ হয়ে যায়। চীন থেকে বই পাঠানো বন্ধ হয়।
তারপর থেকেএন বি এর নিজস্ব বই প্রকাশনা আরো বাড়ে। লক্ষণীয় ন্যাশনাল বুক এজেন্সির বেশ কিছু বই বছরের পর বছর পাঠক মহলে সমাদৃত হয়ে আসছে। এর মধ্যে উল্লেখ করতে হয় রেবতী বর্মনের লেখা সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ, মুজাফফর আহমেদ এর লেখা আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি , ও কাজী নজরুল ইসলাম :স্মৃতিকথা, ই এম এস নাম্বুদিরিপা দের লেখা এক কমিউনিস্টের স্মৃতি মন্থন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভারতীয় দর্শন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরকালের গল্প সংগ্রহ, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ইস্পাত প্রভৃতি। জ্যোতি বসু, সরোজ মুখোপাধ্যায়, অনিল বিশ্বাস, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু প্রমূখ নেতৃবৃন্দের লেখা অনেক বই এন বিএ প্রকাশ করেছে। ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

বর্তমানে এনবিআর দুটি শাখা রয়েছে কলকাতায় ,। এছাড়া রয়েছে বিধান নগর মেদিনীপুর ,দুর্গাপুর ,বর্ধমান ও শিলিগুড়ি শাখা।
এই মুহূর্তে বাংলা ,ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু মিলিয়ে তিনশ’র বেশি বই রয়েছে এন বি এর পুস্তক তালিকা য়। এতে আছে চিরায়ত মার্কসবাদী বইপত্র, প্রবন্ধ ,দর্শন, ইতিহাস বিজ্ঞান ,স্মৃতিকথা ,গল্প-,উপন্যাস, অনুবাদ সাহিত্য, শিশুসাহিত্য ,কবিতা-ছড়া প্রভৃতি বই। অনলাইনে এই বই বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রত্যেক বছর পশ্চিমবঙ্গে শারদ উৎসবের সময় রাজ্যজুড়ে অজস্র বইয়ের স্টল হয়, তার সিংহভাগ জুড়ে থাকে এন বি এর বই।
সংস্থার কাউন্টার থেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্যান্য প্রগতিশীল রুচিশীল প্রকাশনা সংস্থার অনেক বই বিক্রি হয়। বই দেখে বেছে কেনার সুযোগ আছে। অনলাইনে বই বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

বর্তমানে এক প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে বিরাজ করছে। বই প্রকাশ ও বিক্রির ক্ষেত্রে অনেক বাধা। তাছাড়া এই মুহূর্তে করনা ভাইরাসের প্রকোপ পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থার মত এন বি এ কেও আঘাত হেনেছে। তবু ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লড়াই চালিয়ে যাবে। আদর্শে অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।


One Reply to “এন বি এ: আট দশকের পথ চলা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।