পাপিয়া মজুমদার: চিন্তন নিউজ:২৯শে মে:– দিল্লীতে গতকাল একটি সাংবাদিক সম্মেলনে কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা বলেন যে , স্বাধীনতার পর এই কৃষক আন্দোলন এক ঐতিহাসিক আন্দোলন, যা দেখতে দেখতেই ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। যে আন্দোলনের ভাগীদারি হয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
সিংঘু, টিকরি,গাজীপুরে এই কৃষক আন্দোলন চলেছে আজকে প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হলো। স্বাধীনতার পর এই কৃষক আন্দোলনই হলো সর্ববৃহৎ আন্দোলন। এতো বড় দীর্ঘ সময় ব্যাপী আন্দোলন স্বাধীনতার পরে এর আগে আর হয়নি। তারচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো ৫০০ সংগঠন একসাথে কাজ করছে গত ছয় মাস ধরে। এর আগে এতো বড় সু-সংঘবদ্ধ আন্দোলন কখনো হয় নি।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, নানাভাবে বদনাম দিয়ে আসছে। নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েও এতো শান্তিপূর্ণ আন্দোলন স্বাধীনতার পরে আর হয়নি। এইরকম একটা আন্দোলন যে কোনো গনতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেউ কখনো সহজে আন্দোলনের রাস্তায় যেতে চায় না। যখন কেউ আক্রান্ত হয় কিংবা অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন উপায়ান্তর না দেখে আন্দোলনের পথ বেছে নেন।হান্নান মোল্লা বলেন, “আমরা তখনই আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছি। যখনই দেখলাম কেন্দ্রীয় সরকার যে তিন কৃষি বিল তৈরি করেছে, তা কার্যকর হলে দেশের কৃষকেরা শেষ হয়ে যাবে। তাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারা ক্রমশ ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে যাবে। কয়েকজন কর্পোরেটদের হাতে গোটা ব্যবস্থা চলে যাবে। এফ সি আই উঠে যাবে। গোটা কালোবাজারি চরম জায়গায় পৌঁছে যাবে। এমনিতেই কৃষক তার ফসলের নূন্যতম দাম পাচ্ছেনা। এই আইন প্রয়োগের ফলে আরও পাবেনা। এখন মান্ডিতে কিছুটা হলেও দাম পাচ্ছে। এই কালা আইন প্রয়োগের ফলে এর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। যে কোনও দাম তারা দেবে। কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে লোকসানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিতে হয়। এ অব্দি প্রায় চার লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে লোকসানের কারণে। যার কারণে আমরা কৃষকদের ফসলের নূন্যতম দাম পাইয়ে দেবার জন্য লড়াই করছি।”
যে কোনো গনতান্ত্রিক দেশের মানুষ তার অসুবিধার কথা বললে, সরকার তা সহানুভূতির সাথে শোনে ও তা সমাধানের চেষ্টা করে। আর এটাই গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র হওয়া উচিত। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ এতো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই আমাদের কৃষকরা লড়াই করে যাচ্ছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই তিন কৃষি বিল তাদের সর্বনাশের কারণ। এই সময়ে সরকারের উচিত কৃষকদের দাবি গুলো কে মর্যাদা দিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করা। কিন্তু এখনো অব্দি কোনো আলোচনা করে সমাধানের পথে যাচ্ছেনা সরকার।
আমার বিশ্বাস একমাত্র কৃষক ও সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। কোনো ও তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন নেই। এ রকম একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে যখন ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলো, তাতে পরিস্কার প্রমাণ হয় যে, সরকার তার সমাধান চায়না। তাদের যে কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষা করার আইন, তা জোর করে কৃষকদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। দেশের রেল,তেল,এল আই সি সমস্ত কিছুই গোটা কয়েক কর্পোরেট দের হাতে তুলে দিচ্ছে। এখন জমিটাও সেই কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। এদের ব্যবহার দেখেই তা প্রমাণিত আজ।
কিভাবে জমি কর্পোরেটদের হাতে চলে যাবে, কিভাবে কৃষকেরা ক্রীতদাসে পরিণত হবে – সে সব বিষয়ে হাজারো বার বোঝানোর চেষ্টা করা সত্বেও সরকার কর্পোরেটদের কথা গুলো জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় কৃষকদের উপর।
এটা কোনোও গণতান্ত্রিক পন্থা নয়। এটা একটা চরম ফ্যাসিবাদ। এটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধরাশায়ী করা। কৃষকরা যা চাইছে, তা সরকার কিছুতেই করবে না। বরং কর্পোরেটরা যা চাইছে তা চাপিয়ে দেবে কৃষকদের উপর। যখন আমি জানি যে, আমাকে এক গ্লাস বিষ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে পান করার জন্য, জেনেও কি সেই বিষ যুক্ত গ্লাস তুলে নিতে পারি পান করার জন্য! কিছুতেই তা সম্ভব নয়। এই তিন আইন আমাদের কাছে বিষের গ্লাসের ন্যায়। কি করে খাবো তাকে?? আমরা এখনো চাইছি সরকার আমাদের সাথে কথা বলে সেই তিনটি আইন প্রত্যাহার করে নিক ও নুতন করে আইন তৈরি করুক। নুতন আইনে কি কি প্রয়োজন তা সকলে মিলে ঠিক করা হবে।
কিন্তু সরকার কিছুই মানতে রাজি নন। তারা ৮০ কোটি লোকের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। এই অব্দি আমাদের আন্দোলনের ৪৭০ জন আন্দোলন কারী শহীদ হয়েছেন। আর কতো প্রাণের বলি হলে সরকারের হেলদোল হবে!! দিল্লির মতো কনকনে ঠান্ডায়, ফোস্কা পড়ার মতো গরমে, ঝড় বাদলে ও করোনার মতো মহামারীর প্রকোপে ও আন্দোলনে অনড় হয়ে আছে। তারা সকলেই নিশ্চয়ই পাগল নন।
এ হেনো অবস্থায় সরকারের উচিত এগিয়ে এসে সহযোগিতা করা। উপরোন্তু সরকারের কোনো ও সাড়া নেই। কারো কোনো কথা শুনতেই রাজি নন। নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় হয়ে আছে। এটা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী চরিত্র। সমস্ত অংশের লোকেদের সর্বনাশ করে কতিপয় কর্পোরেট দের লাভের চিন্তা করা সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। কৃষকরা চাইছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। সরকার ইচ্ছে করেই বিষয় টিকে দীর্ঘায়িত করে তুলছেন। যাতে আন্দোলন কারীরা সমস্যাগ্রস্ত হয়ে আন্দোলন স্থল পরিত্যাগ করেন। আমাদের আন্দোলনকে প্রতিহত ও ধ্বংস করাই একমাত্র লক্ষ্য। কৃষকরাও তাদের দাবি নিয়ে অনড়। তাই আন্দোলন স্থলে বসে আছ। সকল অংশের মানুষের সমর্থন কৃষকরা পাচ্ছেন। ১০ টি ট্রেড ইউনিয়ন এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। বড় বড় রাজনৈতিক দল গুলিও এখন মনে করছে কৃষকদের দাবিগুলো সঠিক। তাই তারা ওদেরকে সমর্থন করছে। ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবিরা ও আন্দোলনকে সমর্থন করছে।
গত ২৬ শে মে দিন টিকে কৃষকরা কালাদিবস রূপে পালন করে। সমগ্র দেশে এই আন্দোলন কর্মসূচির ব্যপক সাড়া পাওয়া গিয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের ৫ টি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন ও বেশ কয়েকটি রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে গেছে। সেই সব নির্বাচন গুলিতে কৃষকদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো বিজেপির পরাজয়। এবং তাই হয়েছে সর্বত্র। আগামীতেও তাই থাকবে। ” বিজেপিকে হারাও ” – এই ডাক নিয়ে কৃষক নেতারা বিভিন্ন রাজ্যে জনসভা করেছে কারণ বিজেপি সরকার কৃষকদের কথা শুনছেন না, তাই আমাদের শত্রু এরা। তাই তাদের হারানোই একমাত্র লক্ষ্য আমাদের এখন।
কৃষকরা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। কৃষকেরা শুধু মাত্র অন্নদাতা নয়, ভোটদাতাও। উত্তর প্রদেশ পঞ্চায়েত নির্বাচনে এর ফল প্রতিফলিত হয়েছে। আগামীতে উত্তরপ্রদেশ, গোয়া,উত্তরাখন্ড এবং পাঞ্জাবের বিধান সভা নির্বাচন রয়েছে। সেখানে ও একেই স্লোগান থাকবে কৃষকদের। পরবর্তী মিশন উত্তর প্রদেশ।
কৃষক রা, আন্দোলনে সামিল হতে আহবান করলে অচিরেই ২০লক্ষ লোক এসে সামিল হবে তাতে কোনো ও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই মহামারীর কথা মাথায় রেখে তা করচে না। কৃষক দের আন্দোলন চালিয়ে যাবে, তাতে কিছু লোক আসবে আবার কিছু যাবে এই মহামারীর কথা মাথায় রেখে। কৃষকেরা মরে যেতে রাজি, কিন্তু আন্দোলন ছাড়তে রাজি নন, যতক্ষণ তাদের দাবি আদায় না হবে। আজও ৫০০ সংগঠন একসঙ্গে রয়েছে কৃষকদের সমর্থনে। কৃষকদের দৃঢ় মনো বলের জন্যই আজও এই আন্দোলন জারি আছে।
এই আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলন। গত ছয় মাসে আন্দোলনের একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পরেও এই কর্মসূচি জারি থাকবে।আগামী ২৮ ও ৩০ শে মে আবারও বৈঠক হবে। সেখানেই আগামী কর্মসূচি স্থির হবে।।”
Congratulations