কলমের খোঁচা রাজনৈতিক

প্যারি কমিউনের ১৫০ বছর ——


শ্রীরূপ গোপাল গোস্বামী : চিন্তন নিউজ:২৯শে মে:– আজ থেকে ১৫০ বছর আগে পৃথিবীর বুকে প্রথম একটি শ্রমিক শ্রেণি প্যারিস শহরে খুব স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা দখল করেছিল। যা টিকেছিল মাত্র ৭২ দিন। এতোদিন যে বিষয় ছিল তত্ত্বগত, যা ছিল কল্পনার তাকে এই প্রথম মানুষ বাস্তবে দেখার সুযোগ পেলো। ১৮৭১ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২৮ মে। যা প্যারি কমিউন নামে খ্যাত।

ফ্রান্সের তৎকালীন শাসক সম্প্রদায় সে দেশের মানুষকে এক যুদ্ধের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। দেশকে প্রুশিয়ার ক্রীতদাসত্বে পরিণত করার প্রয়াস নিয়েছিল ওই শাসক সম্প্রদায়। তাদেরই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল প্যারিসের শ্রমিক শ্রেণি। সংগঠিত করেছিল প্যারিসের জনগণকে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৮৪৮ সালের বিদ্রোহের শিক্ষা নিয়ে প্যরিসের শ্রমজীবী জনতা পথে নেমেছিল।

প্যারিসের প্রতিটি প্রশাসনিক জেলায় তৈরি হয়েছিল নাগরিক কমিটি। প্রতি নাগরিক কমিটি থেকে চারজনকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল কমিউনের কেন্দ্রীয় কমিটি। সদস্যরা সকলেই ছিলেন শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি। কেন্দ্রীয় কমিটির তরফে কমিউনের সকল সমিতির নির্বাচনের কাজ হয়েছিল ২৭ মার্চ। জনতার মিছিলে পা মিলিয়েছিল নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠেছিল গোটা প্যারিস। থেমে থাকেনি প্রতিবিপ্লবীরা। তারাও ভার্সাই ছুটেছিল তাদের প্রভুদের কাছে এ খবর পৌঁছে দিতে।

কমিউনের সর্বহারা চরিত্র বজায় রাখতে পরিত্যক্ত কারখানাগুলো দখল করে কাজ চালু করে। শ্রমিকদের ওপর জরিমানা বন্ধ করে। বেকারিগুলিতে নাইট শিফটের কাজ বন্ধ করে দেয়। চার্চের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে তা সামাজিক ব্যবহারে লাগানো হয়। অনাথ, বিধবা, দরিদ্র, বিরোধী সকলকে রুটি পৌঁছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি কমিউনের সীমাবদ্ধতাও ছিল বেশ কিছু। ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কি ভাবে ব্যবহার ও পরিচালনা করবে সে সম্পর্কে কমিউনের কোনও সম্যক জ্ঞান ছিলনা। সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে এঙ্গেলস লিখেছেন, “বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, নিশ্চিতভাবেই সেটা হলো পবিত্র সম্ভ্রম। সেই সম্ভ্রম নিয়েই তারা ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্সের দোরগোড়ায় শ্রদ্ধাবনত চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকল।” শ্রমিকরা প্যারিসের দখল নিলেও ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ করেনি অথবা ভার্সাই পৌঁছে প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণ করতেও বাধ্য করেনি। অ্যাডলফ থায়ার্সের সরকারকে বসে থাকার সুযোগ করে দিয়ে প্যারি কমিউন নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল।

কমিউনের সক্রিয়তার অভাবে থায়ার্স তার সরকারি লোকজন ও সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভার্সাই পালিয়ে যেতে পেরেছিল। চেষ্টা করলেই তাদের অবরুদ্ধ করা যেতো এবং সৈন্যবাহিনীকে কমিউনের পক্ষে আনা সম্ভবপর হতো। থায়ার্স প্রুশিয়ার সাথে প্যারিস প্রত্যাঘাতের আলোচনা শুরু করে। কমিউনার্ডরা ব্যারিকেড গড়ে তোলে। প্রতি- আক্রমণকে ঠেকানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন প্রতি- আক্রমণ নেমে এলো তাকে প্রতিহত করতে পারলো না কমিউনার্ডরা। প্রতিটি রাজপথ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো। ভার্সাইয়ের সেনাদল নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে কমিউনার্ডদের। যাদের গ্রেপ্তার করা হয় তাদের ধরে নিয়ে যায় পেরে লাচাইস কবরখানায়। সেখানে দেওয়ালের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে খুন করা হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ভার্সাইয়ের সেনাবাহিনী প্যারিসের ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। ২৮ মে প্যারি কমিউনের পতন ঘটে।

প্যারি কমিউন প্রসঙ্গে কুগেলম্যানকে লেখা মার্কসের চিঠিগুলির সংকলনের মুখবন্ধে লেনিন লেখেন, “কখনও কখনও ইতিহাসে এক একটা সময় এসে হাজির হয়, কোনও ব্যর্থ কারণে হলেও, জনতার একটা সংগ্রাম প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তাদেরই ভবিষ্যতের শিক্ষার জন্য, তাদেরই পরের লড়াইয়ের প্রশিক্ষণের জন্য।” প্যারি কমিউন হলো আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির কাছে একা শিক্ষামালা। পৃথিবীর দেশে দেশে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব গড়ে তুলতে প্যারি কমিউন হলো এক বাতিঘর।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।