বিনোদন

সিনেমা সমালোচনা : ‘এক যে ছিল রাজা’ – সংঘমিত্রা গোস্বামী


পুনর্নিমিত চলচ্চিত্র কি সবসময়ই মূল চলচ্চিত্রের ছায়ামাত্র?
‘এক যে ছিল রাজা’ এমন একটি ঘটনা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র যেটি আগে উত্তম কুমার অভিনীত ‘সন্ন্যাসী রাজা’ চলচিত্রের নতুন রূপ। ‘সন্ন্যাসী রাজা’ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের মহানায়ক উত্তম কুমারের অতি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলির একটি। ১৯৭৫ সালে পীযুষ বসুর পরিচালনায় এটি নির্মিত হয়। এই দুটি চলচ্চিত্রেরই মূখ্য উপজীব্য ভাওয়াল রাজার কাহিনী ও ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা, যেটি বোধ হয় রূপকথাকেও হার মানায়।
ভাওয়াল এস্টেট (বর্তমানে বাংলাদেশের গাজীপুর জেলা) এর রাজা রাজেন্দ্র নারায়ান রায়চৌধুরীর তিন পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ২৫ বছর বয়সে কিছুটা রহস্যময় মৃত্যু হয় এবং শোনা যায় দেহ দাহ হয়নি। ১২ বছর বাদে হুবহু একই দেখতে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয় এবং ওনাকেই মেজকুমার বলে ওখানকার সবাই মেনে নেন। বিখ্যাত ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলায় উনি জিতে যান ও সম্পত্তি ফিরে পান।
এবার চলচিত্রের কথায় ফিরে আসা যাক। ২০১৮ সালে দুর্গা পুজোয় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এক যে ছিল রাজা’ র পরিচালক সৃজিত মুখার্জির উপর বিরাট চাপ ছিল। দ্বিতীয়বার একই পটভূমি নিয়ে চলচিত্রায়ন, যেটি নিয়ে টেলিসিরিয়ালও হয়ে গেছে। কিন্তু কি দৃশ্যায়ন, কি অভিনয়, কি আবহসংগীত সবক্ষেত্রেই সিনেমাটি অসামান্যতার পরিচয় রেখেছে। মূল ঘটনাটি মোটামুটি অবিকৃত রেখে যেন দূর থেকে দেখা দর্শকের মতো নৈব্যক্তিক ভাবে ঘটনাবলী উপস্থাপিত হয়েছে এবং নদীর স্রোতের মতো সাবলীল ভাবে কাহিনীপট উদ্ঘাটিত হয়েছে। কোথাও অনাবশ্যক কোনো মোচড় নেই, অথচ আবেগঘন দৃশ্যগুলি অতি স্বাভাবিক ভাবে বুকে মোচড় দেয়। সন্ন্যাসীকে ভাই বলে বোন যখন চিনতে পারে, রোগসজ্জায় শায়িত রাজা যখন রাজার মতো মরতে চেয়ে ইনজেকশন না দেওয়ার কাতর অনুরোধ করে, দৃশ্যগুলি আপনা থেকেই মর্মে আঘাত করে। অবিস্মরণীয় রাজার ভূমিকায় যীশু সেনগুপ্তের অভিনয়, অভিনেতাকে ছাপিয়ে চরিত্রটি বেরিয়ে এসেছে। পোশাক ও সাজসজ্জা একেবারে যথাযথ। জয়া এহসান বাংলায় কোমল- হৃদয়া স্নেহময়ী বোনের চরিত্রে অনন্যতার সাক্ষর রেখেছেন। রাজার শ্যালক সত্য ব্যানার্জীর চরিত্রটি জটিল ও challenging যেটা অনির্বান ভট্টাচার্য বেশ ভালো ভাবেই করে দেখিয়েছেন। ডাক্তার অশ্বিনী দাসগুপ্ত হিসাবে রুদ্রনীল ঘোষ যেটুকু স্বল্প পরিসরে চরিত্রায়ন করা যায়, করেছেন।
তবে কিছু ব্যাপার মানতে পারা একটু শক্ত। প্রথমত রাজা ইংরেজি ভাষা না জানা সত্ত্বেও কোর্টে জজের কথায় যে ভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তাতে মনে হয়েছে উনি রীতিমতো বুঝেছেন। দ্বিতীয়ত দুই উকিলের চরিত্রে অঞ্জন দত্ত ও অপর্ণা সেন এর অভিনয় কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ওনাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা তুলে ধরা নিরর্থক লেগেছে। তাছাড়া প্রায় ১০০ বছর আগে মহিলা উকিলের উপস্থিতি কতটা স্বাভাবিক সেটাই বিচার্য। আর অপর্ণা সেনের মুখে পুরুষতন্ত্র বিরোধিতা ও নারীস্বাধীনতার জয়গান ওই সময়ে অবিশ্বাস্য। তৃতীয়তঃ জ্ঞান ও বোধ নিয়ে রাজা মহেন্দ্র বিয়ে করার পরেও যখন বলেন তার বিয়ে হয়েছিল কিনা এবং বউ বাচ্চা মেয়ে, এটা হাস্যকর। রাজনন্দিনী পাল কে অন্তত বাচ্চা মেয়ে মনে হয় না।
এবার আমি ঐ একই কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে বানানো মূল চলচ্চিত্র সন্ন্যাসী রাজার চলচিত্রায়ন নিয়ে কথা বলবো। প্রথমতঃ এটির কাহিনী মূল কাহিনী থেকে অনেকটাই আলাদা, বেশ খানিকটা কল্পনাপ্রসূত উপকথার মতো (Myth)। সেই অনুযায়ী চরিত্রগুলিও আলাদা রূপ নিয়েছে। শ্রেষ্ঠাংশে রাজা সূর্যকিশোরের ভূমিকায় উত্তম কুমার অনবদ্য অভিনয় করেছেন। কিন্তু খোলাখুলি যদি বলি উনি ওনার নায়কোচিত ক্যারিশমা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি (পাঠক আমায় ক্ষমা করবেন, আমিও ওনার বড়ো অনুরাগী)। কোথাও যেন ওনার গ্ল্যামার রাজা এবং সন্ন্যাসী এই দুই রূপ ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। রানী ইন্দু চরিত্রে সুপ্রিয়ার চরিত্রটি বেশ confusing মনে হয়েছে। উনি যখন জানলেন ডাক্তার মানুষটি সুবিধার নয় তখন কেন বাইরে থেকে চিকিৎসকের ব্যবস্থা করলেন না? উনি যখন স্বামীকে অভিমান সত্ত্বেও ভালোবাসতেন তখন কেন বিদেশে সেই ডাক্তারের হাতেই রাজাকে সম্পূর্ণ সমর্পন করলেন? রাজার মৃত্যুর পর যখন পূর্ণ উদ্যমে রাজত্ব সামলানো দরকার তখন উদাসীন হয়ে ডাক্তারের মানসিকতা জেনেও কেন পুজাপাঠ নিয়ে থেকে তার অনুপ্রবেশকে সুবিধা করে দিলেন? সুপ্রিয়া দেবীর অসাধারণ অভিনয় সত্ত্বেও চরিত্রটি খুবই দুর্বল। ডাক্তার চরিত্রে রবিন কুমার সার্থক খলনায়ক। সুলতা চৌধুরী বিলাসীর চরিত্রায়ন ও চমৎকার। আর বাকি সবাই যথাযথ। আবহসংগীত এই সিনেমাতেও চমৎকার।
অতএব এই দুটি চলচ্চিত্রের আলোচনায় বোঝা গেল পুনর্নিমিত ছবিটি কোনোভাবেই নিকৃষ্ট নয়। কোথাও হয়তো পুরোনোটিকেও ছাপিয়ে গেছে। আদালতের রায় বেরোনোর পর সত্যেন্দ্র বোনকে বলেন তার কোনো স্বামী অতীতেও ছিল না, বর্তমানেও নেই এবং মদের নেশায় আসক্ত বেশ্যা বাড়ি যাওয়া মানুষ কখনো কারো স্বামী হতে পারে না। তার উত্তরে মেজকুমারের বোন বলে ওঠেন, বেশ্যাবাড়িতে যাওয়া নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা তার চেয়েও বড় অন্যায়। এখানে দর্শক হল থেকে বেরোন জীবনের ভালমন্দের বিচার নিয়ে এক বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন হযে। মূল সিনেমা সন্ন্যাসী রাজার যদি নিরাসক্ত রাজার সন্ন্যাসজীবনে ফিরে যাওয়া দর্শকদের মনে অনুরণন তোলে, তবে এক যে ছিল রাজার দর্শকদের মনে এই প্রশ্নটি আলোড়িত হবে।


One Reply to “সিনেমা সমালোচনা : ‘এক যে ছিল রাজা’ – সংঘমিত্রা গোস্বামী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।