কলমের খোঁচা বিনোদন

কথোপকথন–মন কেমন করা এক অভিজ্ঞতা। বিশেষ প্রতিবেদন: স্বাতী শীল


চিন্তন নিউজ: ৫ ই নভেম্বর:– লোকটির নাম চাঁদ মাল।বাড়ি অগ্রদ্বীপ, কাটোয়া।সেখান থেকে আসেন প্রত্যেক বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় নিজের হাতে তৈরি করা কিছু কাঠের বাঁশি,আর নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি করা একতারা নিয়ে বিক্রির জন্য।ওনাকে আমি চিনিনা। কখনো দেখিনি দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি হয়ত।এরকম রাস্তা ধারে ধারে কত দোকান থাকে। পসরা নিয়ে অনেকে বসে কারো নজর থাকে তাদের দিকে?যেখানে বসে ছিলেন তার আশেপাশে দুটো বড় বড় দোকান একটা হচ্ছে বিভিন্ন রকম অর্নামেন্টস এর দোকান।চুরি,হার,বালা।১০০ টাকা থেকে শুরু।শেষ কোথায় জানিনা।অন্যদিকে ব্যাগের দোকান সেগুলো বেশ ভালো দামি ১০০ টাকায় ব্যাগ,২০০ টাকায় ব্যাগ।ভদ্রলোক তাদের মাঝখানে কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছিলেন।

হঠাৎ করেই উনি আমার চোখে পড়লেন। উনি হাতে একটা একতারা নিয়ে টুঙটুঙ করে বাজাচ্ছিলেন।খুব সুন্দর সুর উঠছিল ওটা থেকে।সেটা দেখে আমি দাঁড়ালাম।ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম এটার দাম কত? এক মুহূর্তের মধ্যে বললেন ৫০ টাকা আমি ভীষন অবাক।এই একই জিনিস যখন অন্য কোনো বড় দোকানে জিজ্ঞাসা করি তখন যা দাম বলে সেটা সাধ্যের বাইরে থাকে।অথচ উনি বললেন, ৫০ টাকা।আর বাঁশির দাম,২০ টাকা।জিজ্ঞাসা করাতে বললেন যে,নিজের হাতে তৈরি এগুলো আমার।

একটু দাঁড়িয়ে গেলাম ওনার সাথে কথা বলবো বলে।কথা বিশেষ কিছুই ছিল না। তবুও জানতে ইচ্ছে হল,,এটা কি আপনি নিজে বানিয়েছেন?উনি বললেন হ্যাঁ নারকেলের মালা দিয়ে এটা আমার নিজের হাতে তৈরি।বিগত ৩০ বছর ধরে আমি এখানে আসছি।তার আগে আমার বাবা আসতেন।সেই যে বছর ইন্দিরা গান্ধী মারা গেলেন,চারিদিক থেকে সব বন্ধ করে দিয়েছিল।আমার বাবা তিনদিন ধরে একটা বাড়িতে লুকিয়ে বসেছিল। বেরোতে পারেনি ভয়েতে। যদি পুলিশ ধরে।সবকিছু আস্তে আস্তে যখন শান্ত হলো তখন বাবা বাড়ি যেতে পেরেছিল।তারপর তো আমি আসছি আজ কত বছর থেকে। যখন প্রথম আসতাম তখন ১১ টাকা করে চাঁদা দিতাম।আদি মায়ের মন্দিরের সামনে একটা ছোট্ট জায়গায় বসতাম।এখন অনেক টাকা লাগে একটা দোকান দিতে গেলে। ৭০০০-৮০০০ করে ভাড়া দিতে হয়। আমি কোথায় পাব এত টাকা?আমার কাছে কি এত পয়সা আছে?এইতো সামান্য ক’টা জিনিস।তাও বিক্রি হয়না।অন্যান্যবার তবু বিক্রি হয়েছে। ৬০০ টাকা৭০০ টাকা।কিন্তু সেটাও এবার হল না।

প্রত্যেক বছর দুর্গাপূজার পরে যে লক্ষ্মী পূজা হয়, সেই সময় এসে জায়গা দেখে যেতে হয়।বুক করে যেতে হয়।আমি এবার আসতে পারিনি।খুব শরীর খারাপ ছিল কিন্তু এত বছর ধরে আসছি। একটু চেনা জানা হয়ে।ওরা ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল তুমি আসছো তো?বললাম,আমার খুব শরীর খারাপ।শুনে বলল,তুমি এসো,তোমার একটা জায়গা থাকবে।আমি জিজ্ঞাসা করলাম,আপনাকে এইটুকু জায়গার জন্য কতটা ভাড়া দিতে হচ্ছে?বললেন,এখনো কিছু বলেনি তবে হাজার বারোশো টাকা মত আমার কাছ থেকে নেয় কারণ এতদিনের চেনা।এতদিন ধরে আসছি। অনেক দূর থেকে আসি তো, ওই জন্য আমাকে একটু কম দিতে হয়।তবে এবার বারোশো টাকা দিতে পারব কি না জানিনা।বিক্রি নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাড়িতে কে কে আছে আপনার?বলল আমি আমার বউ আর আমার ছেলেপুলে আছে।বাবা মা গত হয়েছেন।আমি জিজ্ঞেস করলাম,ছেলে কি করে? বলল ছেলে এই কাজই করে।এসব কথার মাঝে একজন এলেন।একটা বাঁশি তুলে নিয়ে বাজিয়ে টাজিয়ে দেখে দাম জানতে চাইলেন।২০ টাকা শুনে বলল,১০ টাকায় দে।গা টা জ্বালা করে উঠল।তারপর বললেন,সেতার টা কত?বাজিয়ে দেখতে গিয়ে বেসুরো ঝঙ্কার হয়ত নিজের কানেই বাজল,বললেন,এটা বাজে জিনিস।

আমি বেশি কিছু করতে পারলাম না।দুটো একতারা,একটা বাঁশি আর একটা অদ্ভুত মন খারাপি মেঠো সুরের রেশ নিয়ে ফিরে এলাম।সেভাবে কখনও প্রার্থনা তো করি নি কখনও,তবুও নিজের অজান্তেই একবার মনে হল,তোমার সব জিনিস বিক্রি হয়ে যাক কাকু।ফেরার সময় একটা অদ্ভুত জিনিস হল আমার সাথে।আর একবারের জন্যও আশপাশের হার দুল গুলো নজরে এল না।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।