কলমের খোঁচা

মোহিত নগরের স্মৃতিতে উজ্জল স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহিত মৈত্র।


দীপশুভ্র সান্যাল জলপাইগুড়ি: চিন্তন নিউজ: ৩০শে মে:- মোহিত নগরে এখন অনেক মৈত্র পরিবার প্রায় একটি পাড়া জুড়েই তাদের বিস্তার। এই পাড়ায় রয়েছে জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কলেজের প্রাতঃ বিভাগের প্রধান করণিক পার্টি নেতা নীলাদ্রি মৈত্রের বাসগৃহ। নীলাদ্রি বাবুর সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের পদবি মৈত্র হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহিত মৈত্র’র সাথে তাদের কোন যোগ নেই। কিছুদূর এগিয়েই এলাকার পুরনো বাসিন্দা জমি দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী পুলক মৈত্র’র বাসগৃহ। উনিও জানালেন যার নামে মহিত নগর অগ্নিযুগের সেই বিপ্লবী মোহিত মৈত্র তাদের পূর্বপুরুষ নন। তবে তিনি ছোটবেলায় শুনেছেন ওই স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহিত বাবুর বাড়ি ছিল জলপাইগুড়ি সোনাউল্লাহ স্কুলের পাশে। এলাকার উত্তর কুমার পাড়া গ্রামের অন্তর্গত কুমারপাড়া অ্যাডিশনাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুভেন্দু সাহা, এই এলাকার ইতিহাস সম্পর্কে অনেকটা ওয়াকিবহাল। তার কাছ থেকে জানা গেল অনেক কিছু। গতকাল ২৮শে এপ্রিল ছিল বিপ্লবী মোহিত মৈত্রর জন্মদিন। শুভেন্দু বাবুর থেকে যেটুকু জানা গেছে তা অনেকটা এই রকম-দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ববঙ্গ থেকে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে জলপাইগুড়ি আসেন। আই. সি.এস হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় অভিভক্ত বাংলা সরকারের জেলা জজের পদে নিযুক্ত ছিলেন। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং এই তিনটি জেলা জুড়ে ছিল তার ‘জজিয়তী’। জজের অফিস অবস্থিত ছিল দিনাজপুর শহরে, কিন্তু তাকে পালা করে জলপাইগুড়ি দার্জিলিং কোর্টে আসতে হত। পরে তিনি জলপাইগুড়ি জেলার ‘প্রশাসক’ নিযুক্ত হন। তার এই প্রশাসক জীবনের স্মৃতিচারণ মূলক লেখা ‘উদ্বাস্তু’। জলপাইগুড়ি জেলায় আগত শত-শত উদ্বাস্তুর পুর্নবাসনের রূপরেখায় ছিল তাঁর আন্তরিক হস্তক্ষেপ। এই ‘উদ্বাস্তু’ গ্রন্থ থেকে ‘মােহিত নগর’ সম্পর্কে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করছি—“শিলিগুড়ি যাবার পথে রেল লাইন যেখানে তাকে কেটেছে সেখানেও অনেক পতিত জমি ছিল। জায়গাটা জলপাইগুড়ি শহর হতে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে। তার যাঁরা মালিক তারা একটি পরিকল্পনা করে সেই জমি অকৃষিজীবী উদ্বাস্তু পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এই জায়গাটি শহরের কাছে বলে আমরাও সে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। এখানে আশ্রয় শিবির হওয়ার পর অকৃষিজীবী উদ্বাস্তু পাঠান হয়েছিল। এই উপনিবেশের নাম দেওয়া হয়েছিল মােহিত নগর কলােনী।”

‘Terrorism in Bengal: a chronological account of violent incidents from 1907 to 1930 (Vol-VI, পৃঃ ৯৫৭)-তে মােহিত মােহনের বিরুদ্ধে অভিযােগের বিবরণ, তথা কেস ডায়রিতে আছে— “On the 9th February 1932, the port police
on certain information, arrested Mohit Chandra Moitra, son of Hemchandra of ‘Natun Bharanga’, police station, Bera, pabna and of 2/A Ganesh Sarkar Lane, Kidderpore on upper circular road,and recovered from his person and 32 bore 5 chambered side- loading revolver bearing No 48 together with 14 cartridge (one 320 bore marked ‘Eley’ and thirteen 320 bore marked ‘Pilone’.
The accused was convicted under section 19 (f) 20 of the Indian
Act on the 18th April 1932, and sentenced under the latter section

মােহিত মােহনকে কারারুদ্ধ হতে হল। প্রথম বছর তিনি আলিপুর জেলে তার অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে ছিলেন। জেলখানায় তাঁর গানে, কৌতুকে, যৌবনােচ্ছল প্রাণাবেগে অন্যান্য বন্দীরা ছিলেন মুগ্ধ। জেলখানার জীবনে গান ছিল মােহিত মােহনের সঙ্গী। এরপরে মােহিত মােহনকে পাঠানাে হল আন্দামান। সেলুলার জেলে। আন্দামান সেলুলার জেলে এর কিছু দিন পরেই শুরু হল সেই বিখ্যাত অনশন ধর্মঘট। মােহিত মােহন এই ধর্মঘটে যােগ দিলেন। অবস্থা যখন চরমে পৌছাল, তখন ইংরেজ কর্মচারীরা জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা শুরু করল। জোর করে নল দিয়ে দুধ খাওয়াবার জন্য তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। অবৈজ্ঞানিকভাবে জোর করে খাওয়ানাের চেষ্টায় তার কষ্ট হচ্ছিল খুব। শরীর ক্রমশ দুর্বল হচ্ছিল। এই অসহ্য কষ্টকর দিনগুলােতেও তিনি গুনগুন করে গান করতেন, ডেকে পাঠাতেন সঙ্গী কালীপদ, সিরাজুল হকদের। এইভাবে তিনি নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত হলেন, তাঁকে জেলখানার হাসপাতালে পাঠানাে হল। সেখানে চিকিৎসার কোনও সুবন্দেবস্ত ছিল না, মােহিত মােহনের কণ্ঠের গান
ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। অবশেষে ১৯৩৩ এর ২৮শে মে তার কণ্ঠের আওয়াজ চিরকালের জন্য থেমে গেল। শহীদ মােহিত মােহন মৈত্রর শেষকৃত্যের কোনও সুষ্ঠু ব্যবস্থা সেদিন হয়নি। জঙ্গলঘাট শ্মশান থেকে তার অগ্নিদগ্ধ দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সমুদ্রের জলে। একইভাবে মােহিত মােহনের মত আরও দুজন অনশনকারী মােহিত মােহনের আগে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। মহাবীর সিং মারা যান ১৯০৯ এর ১৭ই মে, মােহন কিশাের নমদাস মারা যান ১৯৩৩ এর ২৬শে মে। আন্দামান জেলে অনশনকারী এই তিন শহীদের নাম অমর হয়ে আছে। এই তিন শহীদের অন্যতম মােহিত মােহন মৈত্রকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবার জন্যই ‘মােহিত নগর’ নামকরণ।

আরও জানা গেছে বর্তমান যুব আন্দোলনের নেতা সুরাজ দাস এর দুঃসম্পর্কের দাদু তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রকাশ দাস ছিলেন উদ্বাস্তু এলাকা মোহিত নগর স্থাপনের অন্যতম কাণ্ডারী।রবি সিকদার, কংগ্রেস নেতা সুদীপ তলাপাত্র, কংগ্রেস নেতা নরেন দাস , যিনি নকশালদের হাতে মারা যান ১৯৭০/ ১৯৭২ সাল নাগাদ।আর কমিউনিস্ট নেতা প্রকাশ দাস ১৯৪৭/১৯৪৮ সাল নাগাদ মোহিত নগর এর নাম করন করেন এনারা।

বঙ্গেশ্বর রায় লিখেছেন—
“Mohit – a man of striking personality, a good singer and a
youth, full of sprit, will always remain immortal in the world of
martyrs. Mohit Nagar Colony in the district of Jalpaiguri (West
Bengal) is today standing as a tribute to his memory.”
তথ্যসূত্র – কথায় কথায় জলপাইগুড়ি।
লেখক- রঞ্জিত কুমার মিত্র
প্রকাশক- প্রদোষ রঞ্জন সাহা এখন ডুয়ার্স।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।