কলমের খোঁচা

মোদির ভারত ও বহুত্ববাদের সঙ্কট — গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ, ৮ সেপ্টেম্বর: সাতের দশকের একদম শেষ ভাগে জুলাই সংকটের জেরে যখন মোরারজি দেশাইয়ের সরকার ভেঙে যায়, তখনই দেশবাসী কার্যত বুঝতে পারে যে, দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন আসন্ন। চরণ সিং এর নেতৃত্বে একটি জোড়াতালি সরকার তৈরি হলেও সেই সরকারের যে আয়ু বেশিদিন হবে না -একথা সেই সরকারের শপথ গ্রহণের দিনই কার্যত ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন।

পর্দার আড়াল থেকে খেলাটা যে ইন্দিরা গান্ধী জোরকদমে খেলতে শুরু করে দিয়েছেন, এটা বুঝতে আর ভারতবাসীর সেদিন কোনো অসুবিধে ছিল না। চরণ সিং এর সরকার কার্যত সংসদের মুখোমুখি হয়নি। এরপর যে মধ্যবর্তী নির্বাচন, সেই মধ্যবর্তী নির্বাচন উপলক্ষে ইন্দিরা কংগ্রেস সেই সময়ের বিভিন্ন খবরের কাগজে যেসব বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, সেই বিজ্ঞাপনে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল; এক জাতি, এক প্রাণ, একতার উপরে।

জানিনা ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন সময় কালে মোরারজি দেশাই সরকারকে উৎখাত করবার জন্য যেসব উপক্রমের সাহায্য ইন্দিরা গান্ধী নিয়েছিলেন, সেইসব উপক্রম তিনি ক্ষমতায় আসতে পারলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠতে পারে– এই অনুমানটি ইন্দিরার নির্বাচনের আগেই ছিল কিনা। আর সেই অনুমানের ভিত্তিতে তিনি বুঝেছিলেন কিনা, পাঞ্জাব সমস্যা, ভিন্দ্রনেওয়ালে ইত্যাদিকে ঘিরে দেশের জাতীয় সংহতি একটা বড় রকমের সংকটের মুখে আসতে চলেছে— তাই তিনি এক জাতি এক প্রাণ একতার বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই সময়ের খবরের কাগজের পাতা ভর্তি করতেন কিনা।

এমন হাইপোথিসিসের উপরে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব না হলেও এটা খুব জোরের সঙ্গে বলতে হয় যে, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির যে পরবর্তীকালে বহুত্ববাদকে ধ্বংস করে ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’কে ‘ভারতীয়ত্ব ‘ হিসেবে গোটা ভারতবাসীর উপরে চাপিয়ে দিতে চাইছে, হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত ভারতবর্ষের, প্রবাহমান সংস্কৃতিক চিন্তাচেতনা, সামাজিক ধারণা -এগুলির উপড়ে দিতে চাইছে –সেগুলির সাম্প্রতিক অতীত উৎস, ১৯৮০ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রাক্কালে, ক্ষমতায় ফেরার জন্য কার্যত যাবতীয় রাজনৈতিক বোধকে অতিক্রম করে, প্রায় উন্মাদিনী হয়ে ওঠা ইন্দিরার প্রবনতার মধ্যে প্রাথমিকভাবে ছিল কি না।

একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনব্যাপী ধ্যান-ধারণায় ভারতীয় চিন্তা চেতনার মূল উৎস হিসেবে কোনো দিন ‘এক জাতি’র ভাবনা ভাবেননি। ভেবেছিলেন মহাজাতির ভাবনা। তাই সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে তিনি সেই মহাজাতির মিলনক্ষেত্র নির্মাণের সংকল্পে মহাজাতি সদন হিসেবে নতুন সৌধটির নামকরণ করেছিলেন।

এই মহা জাতি গঠনের ভাবনাকে এক জাতি, এক প্রাণ হিসেবে দেখানোর প্রবনতা, ভয়ঙ্কর রকম ভাবে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এককেন্দ্রিক সংস্কৃতির আগ্রাসী মানসিকতার প্রকাশ হয়েছে। তাই একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতে হয় যে, ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীকালে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করে নাগপুরের কেশব ভবন কেন্দ্রিক এককেন্দ্রিক জাতি গঠনের যে চিন্তা-চেতনা, প্রবণতা রাজনৈতিক হিন্দুদের মধ্যে ক্রমশ অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠতে শুরু করে, সেই প্রাবল্যের ভিত কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর হাতেই তৈরি।

পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি যেভাবে এগিয়েছে সেভাবেই সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তি, সংখ্যাগুরুর ভাবাবেগকে পরিচালিত করবার চেষ্টা করেছে। এই বহুত্ববাদী চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে এভাবেই নিজেদের তারা পরিচালিত করেছে। ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরুর প্রচলিত আধ্যাত্বিক ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, এমনকি ট্যাবুর ভিতরেও যুগ যুগ ধরে একটা বহুত্ববাদী সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনা প্রবাহিত হয়ে চলেছে।

উত্তর ভারতের একটা বড় অংশ জুড়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন বাবা খাজা মইনুদ্দিন চিশতির সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার প্রভাব রয়েছে, সেলিম চিশতির উদার মানবিক ধ্যান ধারণার প্রভাব রয়েছে, সেইসব ধ্যান-ধারণাকে কেন্দ্র করে নানা লোকায়ত বিশ্বাস, সেইসব বিশ্বাসের ভেতরে মাদুলি, তাবিজ, কবজ, জল পড়া, তেল পড়ার মতো অতিপ্রাকৃত, অবৈজ্ঞানিক অথচ পরমতসহিষ্ণু ,পরমতের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাশীল একটা ধারণা রয়েছে, তেমনিই বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম মতের ধ্বংসাবশেষের উপরে প্রতিষ্ঠিত নানা ধর্মঠাকুরের দেউল, সত্যনারায়ণের সিন্নি, সাংস্কৃতিক, সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনা এবং বহুত্ববাদের ধারাকেই পুষ্ট করে চলেছে।

আধুনিক ভারতের মানবিক ধর্মপ্রচারের সবথেকে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব শ্রী রামকৃষ্ণ, সারদা দেবীর ব্যক্তিজীবনে বাংলার বাঁকুড়া, হুগলি জেলার যে সমস্ত লোকায়ত দেবদেবীর প্রভাব রয়েছে, সেই সমস্ত লোকজন ও দেবতারাও কিন্তু আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনার অন্যতম ফসল। সারদা দেবী তাঁর জন্মভূমি জয়রামবাটি থেকে কোথাও যাওয়ার আগে প্রণাম করতেন তাঁর বাড়ি থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে অবস্থানরত এক গ্রাম্য দেবতা যাত্রাসিদ্ধিকে।

এই যাত্রাসিদ্ধি কিন্তু হলেন একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলার বুকে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব প্রচার ও প্রসারের অন্যতম ফসল। একদা বৌদ্ধদের পূজিত এই দেবতা কখন যে কিভাবে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের লোকদেবতায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস জানার বা বোঝার মতো মেধা বহুত্ববাদী চিন্তা চেতনাকে ধ্বংস করে, এককেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনাকে ‘ভারতাত্মা’ বলে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য উদগ্রীব একাংশের রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের লোকজন নেই।

যে মহান জাতির কল্পনা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন, সেই কল্পনার বাস্তব ভিত্তিতে কিন্তু তিনি একটি বারের জন্যেও বহু জাতির ভিতরে যে সন্মিলিত প্রবাহ এসেছে, সেই সন্মিলিত প্রবাহ আপন বৈশিষ্ট্য বিস্মৃত হয়ে, নিজের চিরন্তন চিন্তা-চেতনাকে ভুলে গিয়ে একটি যান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক ভাবনায় পরিণত হোক এটা তিনি চাননি।

আজ যাঁরা বহুত্ববাদী ভারতকে এককেন্দ্রিক ভারতে পরিণত করতে চান, তাঁদের প্রধান ও প্রথম লক্ষ্য হলো সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার যাবতীয় ট্যাবু মুক্ত একটি ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’। সেই রাজনৈতিক হিন্দুত্বে দারা শিকো থেকে শুরু করে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, সেলিম চিশতী বা পাথরচাপরি দাতা পীর কিংবা জয়দেব কেন্দুলি মরমীয়া সাধনা, কবীর, নানক দাদু, সন্ত রবিদাস প্রমুখের কোনো রকম ঠাঁই নেই। এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণ, বা তাঁর থেকে ৪০০ বছর পিছনের মানুষ শ্রীচৈতন্য, যিনি ভিন্ন ধর্মে আস্থাশীল হরিদাসকে পরম স্নেহে কোল দিয়েছিলেন, সেই সব সমন্বয়ী চিন্তা চেতনার প্রতীক, বহুত্ববাদের পরম সাধকদের এতোটুকু স্থান নেই।

যুগ যুগ ধরে যে ভারতবর্ষ “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে” র চিন্তা-চেতনায় পুষ্ট হয়েছে, সেই চিন্তা চেতনাকে যাঁরা গলা টিপে হত্যা করছে, তাঁরাই আজ নিজেদের একমাত্র ভারতবর্ষের উত্তর সাধক বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে ভারত শত্রুকেও যুগ যুগ ধরে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছে, অথচ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি, সেই ভারতকে আজ শত্রুর প্রতি শুধু ঘৃণা নয়, বহুত্ববাদী সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার প্রতি আস্থাশীল মানুষকে শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করতে যাঁরা শেখাচ্ছেন, সেইসব লোকেরাই নিজেদের যথার্থ দেশপ্রেমিক, যথার্থ ভারতবাসী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন।

এই বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটিত করবার জন্য এককেন্দ্রিক সংস্কৃতির যাঁরা ধারক-বাহক, সেই রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ষড়যন্ত্র করে চলেছে। মানুষের আধ্যাত্মিক আকুলতা সম্পর্কিত সরল বিশ্বাসকে তাঁরা ব্যবহার করে চলেছে তাঁদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থে।

ভারতবর্ষের প্রবাহমান চিরন্তন মতাদর্শকে তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছে ভুল ধারণা হিসেবে তুলে ধরার জন্য সব রকম ভাবে সচেষ্ট রয়েছে। আধ্যাত্বিক আকুলতাকে কেন্দ্র করে যে পরিমন্ডল আছে, সেই পরিমন্ডলের ভেতরেও যে একটি অর্থনৈতিক প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে, সেই অর্থনৈতিক প্রশ্নটিকে ভুলিয়ে দিয়ে, আধ্যাত্বিক চিন্তা-চেতনা ঘিরে একাংশের মানুষের সরল বিশ্বাসকে সম্পুর্ণ বিপথে পরিচালিত করে চলেছে এই রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি।

এঁদের মূল লক্ষ্য ভারতবর্ষের প্রবাহমান বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনা ধারাকে বিনষ্ট করা। খন্ডিত ভারতের পাকিস্তান বা বাংলাদেশ- সেখানকার সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি যখন যেভাবে পেরেছে নিজেদের দেশে এই বহুত্ববাদী চিন্তা চেতনাকে ধ্বংস করতে চেষ্টার কসুর করেনি। তবু তার ভিতরে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে কিন্তু প্রচলিত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী ৫১ পীঠের অন্যতম দেবী হিংলাজ মাতার পূজার্চনা হয়। সেই পূজার্চনাকে কেন্দ্র করে যে অর্থনৈতিক মানদন্ড, সেই মানদন্ডটি পরিচালিত হয় কিন্তু সে দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ, অর্থাৎ মুসলমান সমাজের মানুষের দ্বারাই।

আবার বাংলাদেশের ঢাকা শহর সন্নিহিত সোনারগাঁ জেলার বারদি গ্রামে সেখানকার ব্রহ্মচারীকে ঘিরে ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় বা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাঁদের যে সাম্প্রতিক অতীত থেকে শুরু হওয়া নতুন করে আবেগ, সেই আবেগকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনীতি একটা গতি পেয়েছে, আর সেই গতি পাওয়ার দরুন সবথেকে বেশি লাভবান কিন্তু হয়েছে সন্নিহিত অঞ্চলের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা বিশ্বাসে পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই বহুত্ববাদী সংস্কৃতি একটা সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে গভীর সংকটের মুখে পড়েছিল। বহু লড়াই, বহু রক্তপাতের ভেতর দিয়ে আজ বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে, সেই সাফল্যের ধারা প্রবাহে সে দেশে আজ সংখ্যালঘুর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি ধর্মীয় অধিকার অনেকখানি সুরক্ষিত।

৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে যে ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ অর্জন করেছিল, নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক কারণে সেই উত্তরাধিকার বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারে নি।পরবর্তীকালে অবশ্য ব্যাপক গণআন্দোলনের ভেতর দিয়ে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্যপথে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সে দেশ এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরিয়ে আনতে পারেনি, এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সমান সত্যি যে প্রয়োগ জনিত দিক থেকে বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পথে গত দশ বারো বছর ধরে বাংলাদেশ অনেকখানি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

ভারতবর্ষের পক্ষে গভীর দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বহু প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, রক্ত ক্ষয়, শহিদের আত্মত্যাগ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে আমরা আজ পর্যন্ত রক্ষা করে আসছি, আমাদের সংবিধানের সেই ধর্মনিরপেক্ষতা, যার মূল স্তম্ভ বহুত্ববাদী, সমন্বয়ী চিন্তা চেতনা –সেই দৃষ্টিভঙ্গি আজ বড় রকমের সংকটের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।

যদি ভারতবর্ষের চির প্রবাহমান এই বহুত্ববাদী, সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে আমরা রক্ষা করতে না পারি, তাহলে আমাদের এই ভারতবর্ষকেই আমরা রক্ষা করতে পারবো না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বহু রক্ত, আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে যে স্বাধীনতা, যে সার্বভৌমত্ব আমরা অর্জন করতে পেরেছি, রাজনৈতিক হিন্দু ধ্যানধারণা নির্ভর, এককেন্দ্রিক চিন্তা চেতনা, সংস্কৃতি যদি ভারতবর্ষের বুকে দেগে দেওয়া হয়, স্বাধীনতার সেই অর্জনকে আমরা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আর রক্ষা করতে পারবোনা।

তাই এই রাজনৈতিক এককেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে, বহুত্ববাদী সাধনার ধারা কে, সমন্বয়ী চিন্তা চেতনার ধারাকে রক্ষা করাই কিন্তু আমাদের কাছে জাতীয় আন্দোলনের সময়কালের মতোই, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিনের মানসিকতার মতোই আরেকটি নতুন লড়াই।আরেকটি নতুন সংগ্রাম।

এই সংগ্রাম আমাদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে যে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছিল, সেই অর্জন তাঁদের বিঘ্নিত হয় পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সপরিবারে শাহাদাত বরনের ভেতর দিয়ে। পরবর্তীকালে নয়ের দশকে ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে, পাক হানাদারদের সহযোগীদের বেইমানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে সে দেশের মানুষ তাঁদের স্বাধীনতার দ্বিতীয় পর্যায় পালন করেছিলেন।

তেমনিই আজ আমাদের ভারতবর্ষের মানুষের কাছে ভারতবর্ষের চির প্রবাহমান, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনাকে রক্ষা করা হলো ‘৪৭ সালে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার একটা বড় রকমের লড়াই। হিন্দু মুসলমান, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে, সংঘবদ্ধভাবে আমাদের বহুত্ববাদী চিন্তা চেতনা, সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনা, সম্প্রীতির চিন্তা-চেতনা বিঘ্নকারী রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, যা কার্যত স্বাধীনতার দ্বিতীয় লড়াই, এই লড়াই লড়তে হবে। এই লড়াই আমাদের জিততেই হবে। জাতীয় আন্দোলনের লাখো লাখো বীরের রক্ত আত্মত্যাগের দোহাই – এই লড়াই আমাদের জিততেই হবে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।