সুপর্ণা রায়, চিন্তন নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর: জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড, এক নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী যা পাঞ্জাব তথা ভারতকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বর্ণ মন্দির যে রাজ্যের প্রধান দ্রষ্টব্য সেই অমৃতসর শহরের আধ মাইল দূরে অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগ, যা আজও ইতিহাসের করাল ছায়া বয়ে বেড়াচ্ছে। এই সেই জালিওয়নাবাগ, যেখানে গত শতকে ঘটেছিল এক নৃসংস, নারকীয় হত্যাকান্ড।
রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজী ১৯১৯ সালের ৩০শে মার্চের পরিবর্তে ৬ই এপ্রিল সত্যাগ্রহ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এই দিন পরিবর্তনের খবরটা ঠিক সময়ে রাজধানীতে পৌছায়নি। হাকিম আজমল খান ও শ্রদ্ধানন্দ ৩০শে মার্চই সত্যাগ্রহ পালন করেন। হিন্দু- মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ সমাবেশ ছিল অভুতপুর্ব। সমাবেশের শেষে সবাই যখন চাঁদনি চকের দিকে যাচ্ছিল তখন পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে আর তাতে ৫ জন নিরীহ মানুষ প্রান হারান।
এরই প্রতিবাদে ১৯১৯ সালে সারাদেশে সত্যাগ্রহ হরতালের চেহারা নেয়। গান্ধীজীকে জালিয়ানওয়ালাবাগে ঢুকতে বাধা দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এই খবর জেনারেল ডায়ার ও ব্রিকসের কানে গেলে তারাও দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং সিভিল লাইনস অতিক্রম করে জালিয়ানওয়ালাবাগের উদ্দেশ্যে রওনা হন। জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রবেশ করতে হলে একটা সরু গলির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ব্রিটিশদের গাড়ী ওই গলিতে প্রবেশ করতে পারবে না। অতএব পায়ে হেটেই সৈনিকরা ওখানে পৌছায় এবং প্রবেশদ্বার দখল করে।
একটা উঁচু ঢিপির উপর দাঁড়িয়ে তারা দেখে নেয় সভা চলছে জোরকদমে। সব বক্তাদের বলা শেষ, দূর্গাদাস বলতে উঠেছেন। তার আগে রাইমান তার স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছেন। ব্রিটিশ মিলিটারিরা চুপিসারে রাইমানের পিছনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বোঝার আগেই ডায়ার গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। বাগের পিছনে পাঁচিল, বেরোবার সব পথ বন্ধ। অসহায় মানুষগুলি পাঁচিল বেয়ে উঠতে থাকে পালাবার জন্য। কিন্তু গুলি করে করে তাদের নামানো হয়। সেই পাঁচিল আজও বুকে বুলেটের ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অগুনতি মানুষ শুধুমাত্র বাঁচার আশায় একটি অপরিসর কুয়োতে ঝাপ দেয়, সকলেরই জীবন্ত সমাধি ঘটে। মাত্র দশ মিনিটে রক্তাক্ত হল বাগ। ৩৩৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক, ৪১ জন বালক আর একটা সাতমাসের বাচ্চার দেহ নিয়ে নির্বাক নিশ্চুপ বাগ। কিন্তু সুত্রের খবর অনুযায়ী প্রায় ১২০০ জন মারা গিয়েছিল আর ১৫০০ জন গুরুতর ভাবে আহত হয়েছিলেন ওই ঘটনায়।
কবিগুরু এই ঘটনার প্রতিবাদে “নাইট” ও “স্যার” উপাধি ত্যাগ করেন। এই সময়ে কবি পাঞ্জাব যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ রাজী হননি কবিকে নিয়ে যেতে। “ডিফেন্স অব এক্ট” তখন দেশের বুকের উপর চেপে বসে। ভয়ে সবাই মুহ্যমান। কবিকে সঙ্গ দিতে কেউ রাজী হল না। তখন কবি গান্ধীজীকে এক বার্তায় জানান তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ যেতে চান, কিন্তু গান্ধীজীও রাজী হলেন না। আসলে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের পাশবিকতা দেখে নির্বাক হয়ে পড়েছিল। গান্ধীজী কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তিনিও এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে “কাইজার-ই-হিন্দ” উপাধি পরিত্যাগ করেন।