কলমের খোঁচা

বিশ্ব শরণার্থী দিবস ও বর্তমান বিশ্ব ভাবনা


বিশেষ প্রতিবেদন: মল্লিকা গাঙ্গুলী: চিন্তন নিউজ:২০ শে জুন:– আধুনিক বিশ্ব সংগঠন জাতিসংঘের সাধারণ সভার ২০০৪ সালের ৪ঠা ডিসেম্বরের অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর ২০শে জুন দিনটি  “আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস” রূপে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই হিসেবে  ২০০১ সালের ২০ শে জুন থেকেই দিনটি সমগ্র বিশ্বে “শরণার্থী দিবস” হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে জানা যাবে, ১৯৫১ সালের শরণার্থীদের অবস্থান নির্নায়ক কনভেনশনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয় ২০০১ সালে। তাই এই বছর থেকেই “বিশ্ব শরণার্থী দিবস” পালন যুক্তি যুক্ত মনে করেই বিশ্ব নেতৃত্ব এই দিনটি বেছে নেন। যদিও এর আগে থেকেই “আফ্রিকান শরণার্থী দিবস” পালিত হয়ে আসছিল। পরে সর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তামাম পৃথিবীর জন্য ২০ জুন দিনটি  বিশ্ব শরণার্থী দিবস রূপে গৃহীত হয়।

বিশ্বের নিরিখে শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থানটি বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সারা পৃথিবীর যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে এই শরণার্থী বা উদ্বাস্তু সমস্যা। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এখন ছিন্ন মূল মানুষের সংখ্যা প্রায় আট কোটি কুড়ি লাখেরও বেশি। সংখ্যাবিদদের হিসাবে বিশ্বে ৯৫ জন নাগরিকে এক জন উদ্বাস্তু। বর্তমান করোনা মহামারীর চলাফেরার বিধি নিষেধের মধ্যেও এই সময়ে প্রায় এক কোটি বারো লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ” ইউ -এন- এইচ- সি- আর” এর মতে বর্তমানে মোট শরণার্থীর মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষই আভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুহারা। সব থেকে বড় কথা হলো,  এই গৃহহারা মানুষের বেশির ভাগই শিশু। আরও মজার কথা হলো বিশ্বের ৮৫ শতাংশ শরণার্থীর আশ্রয়স্থল পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অর্থাৎ উন্নত দেশে শরণার্থী সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে।  বিশ্বের সব থেকে বেশি শরণার্থীতে পরিনত হয়েছে সিরিয়া, ইরাক, ও ইয়েমেনের মানুষ।  বর্তমানে প্রায় এক কোটির ও বেশি সিরীয় নাগরিক বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় নিকটবর্তী ইরাক, কাতার, ওমান বা সৌদিআরব সিরিয়ার গৃহহীন দের কোনো সহায়তা করে না। তাদের যুক্তি হল, তারা  বেশ কিছু বছর সাহায্য করেছে, তাছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থী  বিষয়ক কনভেনশনে তাদের কোনো সাক্ষর নেই। কাজেই তাদের কোনো দায়িত্ব ও নেই। তাদের আরও যুক্তি,  আরব দেশগুলিতে শরণার্থী গ্রহণ করলে দেশের ভিতরে শিয়া -সুন্নী দ্বন্দ্ব বাঁধবে। তাদের অজুহাত, শরণার্থী  নামে বিদেশ থেকে বহু সন্ত্রাস বাদী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটে, যাতে দেশের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। এদিকে বাংলাদেশেও আশ্রয় নিয়েছে মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এক বিরাট সংখ্যক মানুষ।

অনুমান করা হচ্ছে উদ্বাস্তু সমস্যার সঠিক সমাধান না হলে আগামী কয়েক বছরেই ইউরোপের দেশগুলিতেও বহু মানুষ আশ্রয়প্রার্থী হবে। বিষয়টি বিবেচনা করেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক লক্ষ কুড়ি হাজার মানুষকে আশ্রয় দানের পরিকল্পনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ একে “সমুদ্রে শিশির বিন্দু” বলে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া অসংখ্য সমস্যায় আটকে আছে শরণার্থী হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি। যে কোন দেশের পক্ষে উদ্বাস্তু সমস্যা এক ভয়ঙ্কর সংকট। প্রতিবেশী দেশগুলির জন্যও অনুপ্রবেশ যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে শরণার্থী  হিসেবে চিহ্নিত মানুষ গুলি তাদের নিজস্ব ভূখন্ডের পরিচিতি হারিয়ে বছরের পর বছর অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে, সমস্ত দিক থেকে তারা অবহেলিত। উপযুক্ত শিক্ষা দীক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়া এই অনগ্রসর গোষ্ঠী বহুক্ষেত্রেই আগ্রাসী হিংস্র  মানুষে পরিণত হচ্ছে।

এ বছরের “বিশ্ব শরণার্থী দিবসে”র থিম অর্থাৎ প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- “আমরা একসঙ্গে উপশম করি, শিখি এবং দীপ্ত হই- টুগেদার উই হিল, লার্ন, অ্যান্ড শাইন।” অর্থাৎ, সাধারণ দেশবাসীর মতোই শরণার্থীদের উপযুক্ত খাদ্য ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।  সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এরাও মানুষ, তাই মানব শিশুর যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণের প্রধান লক্ষ্য হলো শিশুদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়া। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের এই ছিন্নমূল মানুষদের জীবন সুরক্ষিত করতে উপযুক্ত পরিবেশ গঠনে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। অথচ বিশ্ব শরণার্থী দিবসের মঞ্চে দাঁড়িয়েই বিশ্ব নেতৃত্বের নজরে আসছে “বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি” অনুযায়ী কোটি কোটি মানুষ চরম ক্ষুধার মুখোমুখি। সংস্থার  মুখপত্র টমসন ফিরির মতে, পূর্বাঞ্চলের আফ্রিকার শরণার্থীদের রেশন অর্ধেক করা হয়েছে, টমসন ফিরি জানান, অবিলম্বে অর্থ সহায়তা না পেলে হয়তো ‘খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি’ বাতিল হয়ে যেতেও পারে। বিভিন্ন দেশে শরণার্থী দিবস পালন কালেই “বিশ্বখাদ্য কর্ম সূচি” সংস্থা তাদের সাহায্য দাতা দেশ গুলিকে সাহায্যের জন্য কাতর আবেদন জানাতে বাধ্য হচ্ছে।

আজ শরণার্থী দিবসে মনে করাতে হয়, সমুদ্রতটে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা তিন বছরের সিরিয় শিশু আইলান কুর্দির নিথর মৃতদেহ দেখে সাময়িক বিশ্ব – বিবেক নড়ে উঠলেও শরণার্থী সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো সুরাহা এখনও হয় নি। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই সমস্যার সমাধান একান্ত প্রয়োজন। আজ এই একদিন “বিশ্ব শরণার্থী দিবস” পালন করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। এই কাজে বিশ্ববাসীকে সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সমস্ত প্রকার রাজনৈতিক কূটকৌশল পরিত্যাগ করে সমস্যার গভীরে গিয়ে মিশ্র বিশ্ব রাজনীতির যৌথ প্রচেষ্টার দ্বারা এক যথার্থ টেকসই সমাধান গ্রহণ করতে হবে। পরগাছার মত বিভূঁয়ে অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত অনিশ্চিত জীবনে কোনো রকমে  টিকে থাকা মানুষ গুলো প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হতে হতাশাগ্রস্থ স্বজন হারা মানুষ গুলোই ক্রমশ কুপথে চালিত হয়! একথা মাথায় রেখে তাদের পাশে সহমর্মিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। যদিও বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে কোনো কোনো দেশে শরণার্থীদের যথেষ্ট খাদ্য ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তথাপি বিশ্ব সমস্যার সমাধান একটি আধটি দেশ বিচ্ছিন্ন ভাবে করতে পারেনা। শরণার্থীদের পুনর্বাসনের বিষয়ে জাতিসংঘের একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করা আবশ্যক। একজন মানুষ বা একটা গোষ্ঠীর ছিন্নমূল হওয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বা সামাজিক বৈষম্যের মূল কারন নির্নয়  করে তা প্রশমনের ব্যবস্থা বিশ্বসংস্থাকেই  করতে হবে।

বলা বাহুল্য বিশিষ্ট চিন্তাশীল মানুষের মতে আন্তর্জাতিক আঙিনায় নেতৃত্ব দানকারি দেশ গুলিকেই শরণার্থী সমস্যার সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। জাতিসংঘের সাধারণ সভা সর্বসম্মত ভাবে এমন এক নীতি নির্ধারণ করুক যে নীতি জাতিসংঘের সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র মানতে বাধ্য থাকবে, এমন কি সেখানে “ভিটো” প্রয়োগের পদ্ধতি ও থাকবে না। আজ শরণার্থী দিবসে বিশ্ববাসীর অঙ্গীকার হোক বিশ্বের সমস্ত  শরণাশ্রয়ী মানুষের নিরাপদ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া। বিশ্বমানব জাগ্রত হলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহমর্মিতায় নির্দিষ্ট পথে একদিকে যেমন সারা পৃথিবীর শরণার্থী মানুষ গুলি তাদের অধিকার ফিরে পাবে, তারা ফেলে আসা বাপ ঠাকুর্দার ভিটে ফিরে পাবে এবং মানব জীবনের মূল ধারায় ফিরে যেতে পারবে, অপর দিকে তেমনি সুনির্দিষ্ট “বিশ্ব পুনর্বাসন নীতি” বিশ্বশান্তি স্থাপনে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে।



মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।