কলমের খোঁচা

আচার্য মুহম্মদ শহিদুল্লাহ – গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ: ১০ই জুলাই:- বাংলা ভাষা চর্চার কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আচার্য শহীদুল্লাহর জন্ম অবিভক্ত বাংলার, অবিভক্ত ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে হ’লেও সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং হিন্দু মুসলমানের সমন্বয়ী সাধনা আর চেতনা বিকাশের এই অগ্রদূতকে আমরা এপারের বাঙালি ক’জন মনে রেখেছি ?১৮৮৫ সালের ১০ ই জুলাই শুক্রবার তাঁর জন্ম পিতা মফিজউদ্দিন আহমেদ মা হুরুন্নেসা। উনিশ শতকের বাংলা নিয়ে এপার বাংলায় যে চর্চা হয় তাতে মুসলমান সমাজ কার্যত অনুপস্থিত থাকে ,ফলে সাধারণের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ,গোটা উনিশ শতক ,এমনকি বিশ শতকের প্রথমার্ধেও বাংলার, কি শহর, কি মফস্বলে মুসলমান সমাজ আবদ্ধ ছিল ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতার বেড়াজালে।

কলকাতা শহর থেকে এমন কিছু দূরে নয় , বসিরহাট , দেগঙ্গা অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আচার্য শহীদুল্লাহের পরিবার কিন্তু তাঁদের পুত্রসন্তানের ডাকনাম কোন আরবি-ফারসি অনুশাসন অনুযায়ী না রেখে দেখেছিলেন ‘সদানন্দ’। সমন্বয়ী বাংলার এই প্রবাহমান ধারার কথা আজ সারস্বত জগতের চর্চায় প্রায় অনুপস্থিত ।তাই আমাদের অনেকের ভিতরেই একটা বদ্ধমূল ধারণা এই যে ,বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রায় পুরো অংশটাই আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে নিজেদের দীর্ঘকাল সম্পৃক্ত করেননি ।কিন্তু ক’জন আমরা খুঁজে দেখেছি বারাসাত – দেগঙ্গা এলাকার ভাসলিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে পবিত্র কুরআন শিক্ষা ,দোয়া দরুদ পাঠ ,গুলেস্তা বুসতাও পাঠের ভেতর দিয়েই কেবল বড় হয়ে ওঠেননি শহীদুল্লাহ ।একই সঙ্গে তিনি পড়েছিলেন বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ,দ্বিতীয় ভাগ ।পড়েছিলেন কথামালা, বোধোদয় ।সেই সঙ্গেই পড়েছিলেন মীর মশাররফ হোসেনের লেখা শিশুপাঠ্য ও।

বিশ শতকের গোড়ায় প্রত্যন্ত ভাসলিয়া গ্রামের সওলাতিয়া মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর ,মীর মশাররফ হোসেনের চেতনায় শহীদুল্লাহের শৈশবের বোধ গড়ে উঠেছিল। স্কুলে তিনি পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন সংস্কৃত ভাষা কে ।এই নির্বাচনের কারণ হিসেবে শহীদুল্লাহ নিজেই লিখে গেছেন ;” স্কুলের মৌলভী সাহেবের মারের ভয়ে ফারসি না নিয়ে সংস্কৃত নিয়েছিলাম “( আমার সাহিত্যিক জীবন,মুহম্মদ শহিদুল্লাহ শতবর্ষপূর্তি স্মারকগ্রন্থ,১৯৯০,পৃ- ৭)।

স্কুলে ইংরেজি বাংলা সংস্কৃত তাঁর পাঠ্য ছিল । কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন মহামহোপাধ্যায় সতীশ চন্দ্র আচার্য্য, বিদ্যাভূষণ ,আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ,ডঃ শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়, রায়বাহাদুর খগেন্দ্র মিত্র ,ডঃ আদিত্য কুমার মুখোপাধ্যায় ,ভাষাবিদ হরিনাথ দে, এম ঘোষ ,পি সি বসু প্রমুখ ।
সংস্কৃত অনার্স নিয়ে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে পাশ করবার পর তিনি যখন স্থির করলেন সংস্কৃত এম এ পড়বেন,তখনই শুরু হলো এক অদ্ভুত সামাজিক সমস্যা ।এক ভয়াবহ অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন শহীদুল্লাহ ।পরবর্তীকালে সে সম্পর্কে সুকুমার সেন লিখছেন ;” শহীদুল্লাহ কলেজ এর ভালো ছাত্র ছিলেন । সংস্কৃত অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেছিলেন। তারপর যথারীতি তিনি এম এ পড়বার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ভর্তি হলেন বটে, কিন্তু ক্লাস করতে পারলেন না। যে পন্ডিত এম এ ক্লাসে বেদ পড়াতেন ,তিনি শহীদুল্লাহর মতো অ হিন্দু ছাত্রকে বেদ পড়াতে রাজি হলেন না। শহিদুল্লাহ আশুবাবুর শরণ নিলেন। কিন্তু তিনিও কিছু করতে পারলেন না ।তার পর আশুবাবুর উপদেশেই তিনি কম্পারেটিভ ফিলোলজি বিভাগের নাম লেখালেন।(শক শাস্ত্রবিদ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ- সুকুমার সেন,ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্মারকগ্রন্থ,’৮৫,পৃ- ৬৩)।

এই ঘটনাক্রম বিংশ শতকের প্রথম ভাগে বাংলার সামাজিক প্রেক্ষিতে এতটাই আলোড়ন ফেলে ছিল যে সংবাদমাধ্যমে প্রসঙ্গটিকে শহীদুল্লাহ অ্যাফেয়ার (‘shahidullah affair’) হিসেবে উল্লেখ করা হতো । ‘দি বেঙ্গলি ‘ পত্রিকা তে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের তৎকালীন বেদ বিষয়ক অধ্যাপক সত্যব্রত সামশ্রয়ীর শহিদুল্লাহকে বেদ পড়ানোর বেদ পড়াতে অস্বীকার করার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। দি কমরেড পত্রিকাতেও মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর পক্ষে প্রবল জনমত গঠনের চেষ্টা হয়েছিল।

পরবর্তীকালে দেশ-বিদেশের ভাষাতত্ত্ব সংক্রান্ত যুগান্তকারী গবেষণা শহীদুল্লাহ করলেও যে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি তাঁর গোটা কর্মজীবন টিকে পরিচালিত করেছিলেন তা আজও আমাদের কাছে গভীর শ্রদ্ধা উদ্রেক করে। পেশা জীবনের শুরুতে তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত এবং নিবেদিত প্রাণ হওয়া সত্ত্বেও শহীদুল্লাহের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, আত্মনিবেদিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

সেই সময় গ্রাম বাংলায় কি স্কুল, কি মাদ্রাসায় মুসলমান শিক্ষকদের ‘হুজুর ‘বলার রেওয়াজ ছিল। সীতাকুণ্ডে স্কুলে চাকরি নিয়ে প্রথমেই সকলকে শহীদুল্লাহ বলেছিলেন তাঁকে যেন কোনো অবস্থাতেই ‘হুজুর’ বলে সম্মোধন না করা না হয়।
দেশভাগের কালান্তিক পর্বে তিনি বগুড়ায় কর্মরত ছিলেন। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে তাঁর এক ছাত্র লিখছেন;” একদিন শহিদুল্লাহ সাহেব ক্লাসে এসে অত্যন্ত বিচলিত অবস্থায় বললেন; মানে কি , এরকম ভাবে মানুষ হত্যা করা ইসলামের নীতি নয় ।পাকিস্তান যদি ইসলামী রাষ্ট্র হয় তবে সংখ্যালঘু মানুষের জানমাল রক্ষা করা তার পবিত্র দায়িত্ব ( পাশ্চাত্যের নিত্যসহচর- আতাউর রহমান, পূর্বোল্লাখিত স্মারকগ্রন্থ,পৃ-২১৮)।

বাঙালির আত্মপরিচয় প্রধান বাহন যে তার মাতৃভাষা বাংলা ,সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে জোর গলায় তা বলতে দ্বিধা করেননি শহিদুল্লাহ। আজীবন তিনি সচেষ্ট থেকেছেন অখন্ড ভারতের প্রাচীন সভ্যতার মর্মমূলে প্রবেশে ।তাঁর ‘মদন ভস্ম’, ‘শ্রীমদ ভগবত গীতার একটি পাঠান্তর ‘, ‘ভরত ,কন্ধ ও বিশ্বামিত্র’, হৈহয় কুলের শার্য্যাত শাখা’, ‘ প্রাচীন ভারতে গো বধ’, ‘আর্য জাতির প্রাচীন প্রেম কাহিনী’ ইত্যাদি প্রবন্ধ ভারতীয় সভ্যতার মর্মমূলে প্রবেশের একেকটি সোপান ।

শহীদুল্লাহের লেখা’ বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ’ কিন্তু আচার্য সুনীতিকুমারের ‘ ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ এর আগে প্রকাশিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থের ভূমিকায় শহিদুল্লাহ বলেছিলেন;” আমার এই বাংলা ব্যাকরণ ভাষাজ্ঞ এবং ভাষা শিক্ষার্থী উভয় শ্রেণীর জন্য রচিত ।এই জন্য ই ইহাতে যেমন খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ আছে ,তেমনি সাধু বাংলা ভাষার, সংস্কৃত উপাদানের ও ব্যাকরণ আছে।”

আঞ্চলিক ভাষার অভিধান রচনা আচার্য শহীদুল্লাহে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ।তিনি ধার্মিক মানুষ ছিলেন ,কিন্তু কট্টর ধর্মপরায়ণতার ভিতর দিয়ে এক ধরনের কঠিন , অনড় , প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র যেভাবে গড়ে ওঠে ,তার সঙ্গে শহীদুল্লাহ কে মিলিয়ে ফেললে তাঁর প্রতি চরম অবিচার করা হবে । স্যার আশুতোষ, ভাষাবিদ হরিনাথ দে এবং দীনেশচন্দ্র সেন– এই তিনজনের প্রভাব শহীদুল্লাহের উপরে সর্বত্র ব্যাপি ছিল । তাই তিনি সারা জীবন ইসলামের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বগত এবং আনুষ্ঠানিক সাদৃশ্যের পাশাপাশি হিন্দু এবং মুসলমান এর ভিতর সাদৃশ্যের অনুসন্ধানের রত থেকেছেন ।স্পষ্ট ভাষায় তাই বলেছিলেন ; ” আপাত দৃষ্টিতে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের দুর্লভ ব্যবধান বিদ্যমান। মনে হয় ইহাদের কোন মিলন ভূমি নাই, কিন্তু বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করলে উভয়ের মধ্যে অনতিবিলম্বে মূল ঐক্যসূত্র পাওয়া যায় ।হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্ম ই পরধর্ম সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয় — এই সহিষ্ণুতা অন্য ধর্মমতের শ্রদ্ধা হইতে প্রসৃত(পূর্বোল্লিখিত স্মারক গ্রন্থ,পৃ-৩৭৯)। ১৯৫৯ সালের ১৩ জুলাই আচার্য শহীদুল্লাহ এর জীবনাবসান হয়।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।