কলমের খোঁচা

নারী শহীদ দিবসে বীরাঙ্গনা শহীদ স্মরণে


পাপিয়া ঘোষ সিংহ: চিন্তন নিউজ: ২৭শে এপ্রিল:–১৯৪৯সালের ২৭শে এপ্রিল। কমিউনিস্ট আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন। ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল ভারতবর্ষের প্রথম নারী কমিউনিস্টের তাজা লাল রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল কলকাতার রাজপথ। বন্দি মুক্তির দাবিতে সেদিন কলকাতার রাজপথে মিছিলরতদের ওপর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ গুলি চালালে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী কমিউনিস্ট কমরেড লতিকা সেন। এছাড়া আরও শহীদ হন প্রতিভা গাঙ্গুলি, অমিয়া দত্ত, গীতা সরকার। এরা সবাই ছিলেন নিখিলবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির অগ্রণী কর্মী। যুবকর্মী বিমান ব্যানার্জিও সেদিন শহীদের মৃত্যু বরণ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল নারী শহীদদের অমর স্মৃতিতে চিরভাস্বর। ২৭ এপ্রিলের স্মৃতি আজো শোষিতের মুক্তির লড়াইয়ের জন্য প্রাণিত করে। সেই সকল বীর শহীদদের স্মরণ মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিজ্ঞায়।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তথাকথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের মধ্য দিয়ে ভারত স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীন দেশেও অকারণে গুলি চালিয়ে সাধারণ মানুষের শোষণমুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন কর্মীদের হত্যা করার ঘৃণ্য কৌশল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী। তারা ব্রিটিশদের দেখানো পথেই চলতে লাগলো। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের শ্রেণি চরিত্রের কারণেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রকট হতে থাকে শ্রেণি বিভাজন। শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত মেহনতি মানুষের ওপর আবারও নেমে আসে দমন- পীড়ন- অত্যাচার। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। প্রতিবাদে গড়ে উঠে বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন গণআন্দোলন, কৃষকদের জমি ও শস্যের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। এগুলো ক্রমান্বয়ে ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে। জনগণের জীবন-জীবিকার সংগ্রামের সঙ্গে নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এসময়ে নব পর্যায়ের তে-ভাগা আন্দোলন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভারতের সর্বত্র এই আন্দোলন সাড়া জাগায়। তেলেঙ্গানার কৃষকদের অবিস্মরণীয় সংগ্রাম, বাংলার কৃষক আন্দোলন ও গণআন্দোলন ব্যাপকরূপে দেখা দেয়।

কৃষক আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন এবং নাগরিক অধিকার আদায়ের গণআন্দোলনে গ্রামের কৃষক রমণীরা এবং শহরের মধ্যবিত্ত নারীরা দলে দলে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এরই মাঝে আসে ১৯৪৯ সালের ঐতিহাসিক ২৭ এপ্রিল। মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী লতিকা দাস, অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রথম নারী, যিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। ১৯৩৬ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রথম নারী হিসেবে বাংলার অহংকার লতিকা সেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। । বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল নিখিলবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির উদ্যেগে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রীটে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় যোগ দিয়েছিলেন হাওড়া, হুগলী, চব্বিশ পরগনাসহ সুদূর পল্লিগ্রাম থেকে আসা অনেক মহিলা। এসেছিলেন কলকাতার বস্তিবাসী আর মধ্যবিত্ত মহিলারাও। সভা শেষে একটি মিছিল বের করা হলে বৌবাজার-কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে পুলিশ বিনা উস্কানিতে শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর আচমকা গুলি চালায়। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন কমরেড লতিকা সেন। পুলিশের ছোঁড়া সেই গুলিতে কমরেড লতিকা সেন ও তাঁর সহযোদ্ধা চারজন মহিলা এবং একজন যুবকর্মী শহীদ হন। লতিকা সেনের তখন বয়স ছিল মাত্র ৩৩।

বিধান রায় যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর আমলে পশ্চিমবাংলার কংগ্রেস সরকারের দমন পীড়ন চরমে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টি ও গণসংগঠনগুলির শতশত নেতা ও কর্মীকে বিনাবিচারে কারাগারে আটক করা হয়। রাজবন্দি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। রাজবন্দিদের ন্যূনতম দাবি আদায়ের জন্য কারাগারের অভ্যন্তরে ও বাইরে চলে প্রচণ্ড সংগ্রাম।

শহরের মধ্যবিত্ত মহিলারা লড়াই করছেন, তাদেরই সহযোদ্ধারা বিধান রায় সরকারের কারাগারে সরকারি জুলুমের বিরুদ্ধে অনশন করে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে চলেছেন। সেদিন সরকারের ভাড়াটিয়া সংবাদপত্রগুলি এই সরকারের অত্যাচারের কাহিনি বিন্দুমাত্র প্রকাশ করেনি। সরকারি আদেশকে নতশিরে মেনে নিয়েছে। কিন্তু মা-বোনেরা বীর বন্দিদের ভুলতে পারেননি। কলকাতার জনতার কাছে বীর বন্দিদের ওপর সরকারি অত্যাচারের কথা তাদের জানাতে হবে।কংগ্রেসের কারাগারে সন্তানেরা তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে আর এক মুহূর্তও দেরি নয় — জনতাকে জানাতে হবে সরকারের অত্যাচারের কথা।

রাজবন্দিদের ন্যূনতম দাবি আদায়ের জন্য কারাগারের অভ্যন্তরে ও বাইরে চলে প্রচণ্ড সংগ্রাম। কারাগারের বন্দিদের ওপর পুলিশ গুলি চালাতে দ্বিধা করেনি। দমদমে জেলের অভ্যন্তরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন কৃষককর্মী প্রভাত কুণ্ডু ও ছাত্র কর্মী সুশীল চক্রবর্তী। রাজবন্দিদের মা ও বোনেরা তৈরি করলেন ‘মায়েদের সমিতি’। মায়েদের সমিতির পক্ষ থেকে আবেদন করা হয় — রাজবন্দিদের জেলের অভ্যন্তরে রাজবন্দির মর্যাদা দিতে হবে — কয়েদির মতন ব্যবহার করা চলবে না।

মায়েদের সমিতি এবং নিখিলবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি যৌথভাবে ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতার ভারত সভা হলে একটি মহিলা সমাবেশের আহ্বান করে। সমাবেশের পর ১৪৪ ধারা অমান্য করে মহিলা শোভাযাত্রা শুরু হলো। শত শত নারীর দৃপ্তকণ্ঠে ধ্বনিত হলো রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি। কংগ্রেসের পুলিশের বুলেটের ঘায়ে লুটিয়ে পড়লেন লতিকা-প্রতিভা-অমিয়া-সীতা এবং পথচারী যুবক বিমান।

আর এক বীরাঙ্গনা শহীদ, অমিয়া দত্ত ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ঐ বছর দূর্ভিক্ষের সময় ঢাকা শহরের সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, নারিন্দা, ওয়ারি, তাঁতিবাজার প্রভৃতি একালায় অমিয়া দত্তের নেতৃত্বে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ত্রাণের কাজে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়। ঘরকন্যার সব কাজ করেও অমিয়া ত্রাণ শিবিরে দুঃস্থ অসহায় নারীদের আশ্রয়দানের কাজের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। গেণ্ডারিয়ায় অবস্থিত অনাথ শিশু ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল তার। বিক্রমপুরের আরেক প্রখ্যাত স্বাধীনতাসংগ্রামী ও সমাজসেবী কংগ্রেসনেত্রী আশালতা সেনের কাছ থেকে তিনি এ ব্যাপারে বহু সাহায্য পেয়েছিলেন।

১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার আন্দামান জেল থেকে কয়েকজন বন্দীকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে এলে তাদের মধ্যে কয়েকজন কমরেড গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেন। অসুস্থদের ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ঢাকায় তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। পার্টি থেকে অমিয়াকে অসুস্থ বন্দীদের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দিলে ঐ মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় পুলিশের চোখ এড়িয়ে নার্সের বেশে তিনি পার্টির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, চিঠি এবং তথ্য আদান-প্রদান করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় অমিয়ার পরিবার ভারতে চলে যান। প্রথমে হাওড়ার কদমতলায় ও পরে বাজেশিবপুরে বাসা ভাড়া করেন। সেখানে গিয়েও তিনি পার্টি এবং মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন।১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের ডুবরী ভেরী গ্রামের আন্দোলনে অনেক কৃষক শহীদ হন। 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয়পর্বে যে সমস্ত নারী যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায় অন্যতম ছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে। বিহারের চাঁইবাসায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুরে। তাঁর বাবা মেয়ের নামটি ‘প্রতিভা’ রাখার পেছনেও ছিল সুদৃঢ় পরিকল্পনা। মেয়েটি বড় হয়ে প্রতিভার অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ছড়াবেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠবেন এটাই ছিল বাবার স্বপ্ন। যে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন প্রতিভা। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামই নয়, জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে তাঁকে লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে। নিজে বাঁচা এবং মানুষকে বাঁচানোর সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন। গ্রামের দারিদ্র্যতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন প্রতিভা। তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৪৪ সালে পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে তিনি প্রকাশ্যে পার্টি ও মহিলা সমিতির কাজ করেন। এরপর তিনি পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে হুগলী জেলায় ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে তোলেন। তিনি চব্বিশ পরগণা জেলার মহিলাদেরও সংগঠিতকরণের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে কৃষক আন্দোলনে জোতদারকে ধান না দেবার সংগ্রামে ডোঙ্গাজোড়ায় মেয়েদের সংগঠিতকরণের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডুবিরভেড়ী গ্রামের আন্দোলনে অনেক কৃষক শহীদ হন, যেখানে নারী কৃষকও ছিলেন। এই সময়ে ব্যাপক ধরপাকড়ে বহু কমিউনিস্ট কর্মী কারারুদ্ধ হন। বন্দিদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদার দাবিতে কারাবন্দিরা জেলের ভেতর সংগ্রাম শুরু করলে তাঁদের সমর্থনে বিভিন্ন সংগঠন থেকে এক একদিন প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। ওই বছর ২৭ এপ্রিল মহিলাদের প্রতিবাদ মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চললে তাতে নিহত হন প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায়, লতিফা সেন, অমিয়া দত্ত ও গীতা সরকার। লাল সালাম প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায়। যতদিন মানবসভ্যতা টিকে থাকবে মনুষ্যসমাজের মাঝে বেঁচে থাকবেন ততদিন। ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।