কলমের খোঁচা

প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী মাদাম কুরী র প্রয়ান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি………..


গোপা মুখার্জী : চিন্তন নিউজ :৪ঠা জুলাই:–” সমাজ তাঁকে কষ্ট দিয়েছে অনেক, তবু সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি ।”……আইনস্টাইন
আজীবন সমাজের কল্যাণে বিজ্ঞানের গবেষণার কাজে নিজের জীবন কে উৎসর্গ করেছিলেন যে মহিয়সী নারী তিনিই হলেন প্রথম নোবেলজয়ী মহিলা বিজ্ঞানী মার্জা ক্লোদোৎস্কা ।পরে মাদাম কুরী নামে যিনি পরিচিত ।দু’ বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি ।১৯০৩ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য এবং১৯১১ সালে রসায়নে …পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথক করার জন্য ।
মাদাম কুরী ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর পোলান্ডের ওয়ার্সা তে জন্মগ্রহণ করেন, যেটি তখন ছিল অত্যাচারী জারের অধীনে ।বাবা মা দুজনেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং পেশায় শিক্ষক ।কিন্তু জারদের তাড়ানোর কাজে যুক্ত থাকার ফলে বাবা কর্মচ্যুত হন এবং মা-ও যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হয়ে ১৮৭৮ সালে মারা যান ।পাঁচ ভাই বোনের সংসারে অভাবের মধ্যে বড়ো হওয়া কুরী র পড়াশুনায় উৎসাহ ছিল অফুরান ।ওয়ার্সার গোপন ভাসমান বিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন এবং সেখানেই তাঁর ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন ।জার্মান, রুশ , ফরাসি, পোলিশ ও ইংরেজি ভাষায় তিনি ছিলেন সমান দক্ষ ।দিদি ব্রনিয়া ডাক্তারী পড়তে চলে যায় প্যারিসে তখন মাদামের বয়স মাত্র আঠারো ।সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর ওপর ।অনেক কষ্ট করে একটা কলেজে পড়ানোর চাকরি পেলেন ।কিন্তু চাকরি তাঁর জীবনের শেষ কথা ছিল না ।আরও পড়ার তাগিদে ১৮৯১ সালে ২৪ বছর বয়সে তিনি দিদি ব্রনিয়ার কাছে প্যারিস এ গেলেন এবং সেখানে সরবোন বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ।১৮৯৫ সালে বিয়ে করেন বিজ্ঞানী পিয়ের কুরী কে। শুরু হল জীবনের নতুন অধ্যায় ।ইচ্ছে ডক্টরেট করার। ইকোল পলিটেকনিকে সবেমাত্র অধ্যাপনার কাজ পেয়েছেন । ছবি তোলার জন্য প্লেট পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখতে পান , নতুন প্লেট কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আগেই ছবি তোলা হয়ে গেছে ।কাছেপিঠে কোথাও তো এক্স -রে র উৎস নেই ।তবে হোল কেমন করে? লক্ষ্য করলেন তলার একটি ড্রয়ারে কিছু পিচব্লেন্ড খনিজ কাগজে মুড়ে রাখা আছে। সেখান থেকেই কোন একটা আলো ঠিকরে বেরিয়ে সোজা গিয়ে নতুন নেগেটিভ গুলোর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে ।নতুন একটা দরজা খুলে গেল মাদামের কাছে ।আবিষ্কার করলেন ঐ আলোই হচ্ছে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ।ইউরেনিয়াম এর নানা যৌগ নিয়ে তিনি পরীক্ষা করলেন ।কাজ করতে করতে খটকা লাগলো তাঁর মনে।পিচব্লেন্ড আর চালকোলাইট খনিজ নিয়ে কাজ করছেন মাদাম ।শুধু ইউরেনিয়াম থাকলে যতট তেজস্ক্রিয়তা হবার কথা ছিল দেখা যাচ্ছে তার বেশি ।তবে কি অন্য কোন তেজস্ক্রিয় মৌল লুকিয়ে আছে সেখানে? তন্ন তন্ন করে খুঁজে আংশিক কেলাসন পদ্ধতি গ্রহণ করে আবিষ্কার করলেন নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল পোলেনিয়াম ।পিচব্লেন্ড থেকে মাদাম বের করলেন আরও এক তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম ।আবিষ্কার করলেন রেডিয়ামের ধর্ম ও…… অন্ধকারে আলো দেয় , জলকে ভাঙতে পারে, বায়ুকে আয়নিত করে । প্যারিস বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অধ্যাপক ও ছিলেন তিনি ।এতো কিছুর পরেও ফ্রান্সের সাধারণ সমাজ তাঁকে যথাযথ সম্মান দেখায় নি । একদল সাংবাদিকের দুষ্ট প্ররোচনায় দুঃখে ও অপমানে স্নায়ুরোগের শিকার হয়ে পড়েন তিনি ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আহত সৈনিক দের চিকিৎসার কাজেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ।সেসময় হাসপাতাল গুলোতে এক্স রে সরঞ্জামের অভাব ছিল ।যুদ্ধে আহত রোগী দের সঠিকভাবে এক্স -রে করানোর অর্থ যোগাতে তিনি তহবিল সংগ্রহে নামেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি এসময়২২০ টি রেডিওলজি স্টেশন গড়ে তোলেন। তার মধ্যে ২০ টি ছিল ভ্রাম্যমান ।নিজেও বিভিন্ন স্টেশনে গিয়ে এক্স রে করতে সাহায্য করতেন ।অত্যধিক পরিশ্রম , গবেষণার সময় নিজের জামার পকেটে রেডিয়াম পূর্ণ টেষ্ট টিউব রাখা এবং বিশ্ব যুদ্ধের সময় নিজের তৈরী ভ্রাম্যমান এক্স -রে ইউনিটে কাজ করার মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার ফলে দুরারোগ্য অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগে আক্রান্ত হন তিনি ।এখন আমরা জানি তেজস্ক্রিয়তা আমাদের কি ক্ষতি করে কিন্তু মাদাম তা জানতেন না। ফুসফুস শতজীর্ণ , আঙুলে ঘা ……ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান তিনি । ১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই ফ্রান্সের সাঞ্চেল্লেমজের একটি স্বাস্থ্যনিবাসে মাদাম কুরী র জীবনাবসান হয় ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।