কলমের খোঁচা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস: ডা. স্বপ্না চট্টরাজ


আজ ১৪ ই জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রান বাঁচাচ্ছেন তাদের সম্মান জানানো এবং সাধারণ জনগনকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য। ১৪ই জুন দিবসটি পালনের আরও একটি তাৎপর্য আছে। এদিন জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টিনারের। এই নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন রক্তের গ্রুপ “এ, বি, ও, এবি”(A, B, O, AB)। ১৯৯৫ সাল থেকে এই দিনটি আন্তর্জাতিক রক্তদাতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

প্রতি বছর ৮কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান করা হয়। রক্তদান হলো কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেবার প্রক্রিয়া। এই দান করা রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয় অথবা অংশীকরনের মাধ্যমে ওষুধে পরিনত করা হয়। উন্নত দেশগুলিতে বেশিরভাগ রক্তদাতাই সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসাবেই স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। দরিদ্র দেশগুলিতে বেশিরভাগ রক্তদাতা তাদের পরিচিত জন বা আত্মীয় স্বজনদের প্রয়োজনে রক্তদান করে থাকেন। বেশিরভাগ মানুষের মনে রক্তদানের ক্ষেত্রে ভয় বাধা হিসাবে কাজ করে। তবে কিছু পেশাদার রক্তদাতা আছেন যারা অর্থের বিনিময়ে রক্তদান করে থাকেন। প্রত্যেক সুস্থ ব্যাক্তির উচিত স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসা। এই রক্ত নিরাপদ হয়।

ভারতে১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান শুরু হয়। দেশের প্রথম ব্লাড ব্যাংকটি কলকাতার “অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন এন্ড পাবলিক হেলথ” এ স্থাপিত হয় এবং “রেড ক্রস” দ্বারা পরিচালিত হয়। সেখানে বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী এবং এংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষ মানবতার কারনে রক্তদান করেছিলেন।

ব্লাড ব্যাংক সম্পর্কে কিছু ধারণা :
রক্তদানে সংগৃহীত রক্ত পরবর্তীতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যেখানে সংরক্ষণ করা হয়, তাকে ব্লাড ব্যাংক বলা হয়। সাধারণত ব্লাড ব্যাংক কোনো একটি হাসপাতালের সাথে যুক্ত থেকে রক্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, পরীক্ষা, পৃথকীকরণ ও সঠিক তাপমাত্রায় স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে সংরক্ষনের কাজ গুলি করে থাকে। পরে রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী তা কার্যকর ভাবে ব্যবহার করা হয়।

রক্তের উপাদান অনুযায়ী প্রয়োজন ভিত্তিক প্রকারভেদ গুলি হলো:
১-পুরো রক্ত (Whole blood)- সরাসরি কোনো মানব দেহ হতে আলাদা না করে সঞ্চালন করা হয়।
২-লোহিত রক্ত কনিকা (R.B.C) সমৃদ্ধ রক্ত সাধারণত রক্তাল্পতা (Anaemia) বা আয়রন ঘাটতি যুক্ত (Iron deficiency) রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রকার রক্ত ৪৫দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
৩-প্লাজমা বা রক্তরস (Plasma) সমৃদ্ধ রক্ত যা লিভারের সমস্যা, গুরুতর সংক্রমণ অথবা গুরুতর অগ্নিদগ্ধ (Burn case) রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রকার রক্ত(-)২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ১২মাস সংরক্ষণ করা যায়।
আমাদের দেশে সাধারণত রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন-রোটারি ব্লাড ব্যাংক, ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটি, লায়ন্স ব্লাড ব্যাংক, খুন সংগঠন, জীবন বাঁচান ভারত, থিঙ্ক ফাউন্ডেশন (মুম্বই ভিত্তিক, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য কাজ করে)। এছাড়াও হাসপাতাল গত ভাবেও রক্তদান হয়ে থাকে। রক্তদাতারা রক্তদানের জন্য সরাসরি ব্লাড ব্যাংক গুলির সাথে যোগাযোগ করে থাকে।
স্বেচ্ছায় রক্তদানের আগে জেনে নিতে হবে কারা রক্তদানে সক্ষম
১- বয়স : ১৮-৫৭বছর।
২-ওজন-কম করে ৪৫ (মহিলা) , ৪৭(পুরুষ) কেজি হতে হবে।
৩-হিমোগ্লোবিন লেবেল ১২-১৪মিলিগ্রাম/ডি.এল হতে হবে।
৪-রক্ত চাপ- সিস্টোলিক- ১০০-১৪০, ডায়াস্টলিক-৬০-৯০mm/hg থাকা দরকার।
৫-গত চার মাসের মধ্যে রক্ত দেননি এমন কোনো সুস্থ ব্যক্তি
৬-ছয়মাসের মধ্যে ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগ ও যৌনরোগ মুক্ত এবং বড়ো যে কোনো ধরনের অপারেশন হয় নি এমন ব্যক্তি রক্তদান করতে পারবেন।
৭-মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায়, মাসিক চলাকালীন কিংবা দুগ্ধদানকালীন সময়ে রক্ত দিতে পারবেন না।
৮-এক সপ্তাহের মধ্যে এন্টিবায়োটিক কিংবা এসপিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন কারী এবং একমাসের মধ্যে টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তি রক্ত দিতে পারবেন না।
৯-কোনো নেশা জাতীয় ওষুধ সেবন, একাধিক অরক্ষিত যৌনমিলন কিংবা অপরীক্ষিত রক্ত বা রক্তের উপাদান গ্রহণ কারী ব্যক্তি রক্ত দিতে পারবেন না।

রক্তদানের উপকারিতাও অনেক আছে
১-একজনের দানকৃত রক্ত আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচাবে।
২-রক্ত দান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে অবস্থিত “বোন ম্যারো” নতুন কনিকা তৈরির জন্য প্রস্তুত হয় এবং রক্তদানের দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্ত কনিকার জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। রক্তদান করার মাত্র ৪৮ঘন্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
৩-নিয়মিত রক্ত দান করলে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
৪-গবেষনায় দেখা গেছে যারা বছরে দুই বার রক্ত দেয় তাদের অন্যদের তুলনায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কম থাকে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের।
৫-রক্ত দান করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কম হয়, তাতে মেদবহুলতা কমে।

আমাদের রাজ্য তথা অন্যান্য রাজ্যেও করোনা অতিমারির কারণে রক্তদান শিবির সংগঠিত না হবার কারণে রক্ত সঙ্কট চলছে। করোনা টিকা নিলে বেশ কিছু দিন রক্তদান করা যায় না। তাই “করোনা টিকা নেওয়ার আগে রক্তদান করুন” এই মর্মে আর্জি জানাচ্ছেন বিভিন্ন রক্তদাতা সংগঠন। রক্তের স্বাভাবিক জোগান বজায় না থাকলে যাদের নিয়মিত রক্ত লাগে যেমন-ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়া প্রভৃতি রোগী অসুবিধার মধ্যে পড়বেন। নতুন পরিস্থিতিতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাই টিকা নেবার আগে রক্তদান করে গেলে রক্তের জোগান বজায় থাকবে।
তাই আসুন আমরা প্রত্যেকেই হয়ে উঠি একেকজন রক্ত যোদ্ধা ও অন্যদেরও উৎসাহিত করি স্বেচ্ছায় রক্তদানে।
“দেহের একটু রক্ত দিলে যদি বাঁচে প্রান
ধন্য হবে জনম তোমার মহৎ তোমার দান। “


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।