চিন্তন নিউজ:৫ই জুন:- দুর্গতদের পাশে রাজ্যবাসী থাকুক, চাইছেন না মমতা ব্যানার্জি। নবান্ন থেকে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছেন সরকার ছাড়া আর কেউ ত্রাণ বিলি করতে পারবে না। ত্রাণ বিলিতে বিরোধীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এদিন নবান্ন থেকে দলের বিধায়ক মন্ত্রীদের রোলকল করে সারলেন প্রশাসনিক বৈঠক। জেলাস্তরে ওই বৈঠকেও দলের সভাপতিকে নির্দেশ দেন। কিন্তু ডাক পাননি একজন বিরোধী বিধায়ক, সাংসদ। ”(গণশক্তি ৪ জুন ২০২০)। কেউ হয়তো বলবেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই নতুন নিষেধাজ্ঞায় অবাক হওয়ার মতো নতুনত্ব আর কি আছে ? চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলা আর উচ্ছৃঙ্খলা,ভন্ডামি আর গুন্ডামি, মিথ্যাচার আর স্বেচ্ছাচার এবং সুনিপূণ অভিনয় দক্ষতার ওপর ভর করে শুধুমাত্র ক্ষমতার মধু হস্তগত করার আশু ও দূরপাল্লার লক্ষ্য নিয়ে যে দলের জন্ম, বৃদ্ধি, বিস্তার এতো, সেই দলের অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, হুবহু যা হওয়া উচিৎ সেই লুম্পেন রাজনীতির স্বাভাবিক প্রকাশ!
আবার কেউ হয়তো বা ভুরু কুঁচকে বলবেন,গলা চুলকে শুধু শুধু ঝগড়া করে কি লাভ মশাই, এতো আসলে স্বৈরাচারিণীর বিলম্বিত বোধদয়। করোনা কারনে লকডাউনের প্রথম থেকেই গোটা রাজ্যে পাকাপোক্তভাবে তাঁর পক্ষে যা যা করা আসলে স্বাভাবিক ছিল ধীরে ধীরে তা করতে করতে মাননীয়া আমফান পরবর্তী সময়ে তা চুড়ান্ত করলেন। স্বয়ংসিদ্ধা তিনি আর ঝুঁকি নিতে নারাজ,তার থেকে ভালো এবং বেশী আর কেউ জানে না প্রথমে করোনা হামলা, তারপর আমফান ঝড়ে শুধু বহু দিনের প্রাচীন হাজার হাজার গাছই উপড়ে পড়ে যায়নি, সেই সঙ্গে তৃণমূল নামক দলটারও শেকড়-বাকর উল্টে-পাল্টে আসল কঙ্কাল টাও প্রকাশ হয়ে গেছে। জনজীবনে করোনা হামলার ভয়াবহতা, এর ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং লকডাউনের কারনে মানুষের, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এতসব আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে বুঝেই উঠতে পারেন নি। রাজনীতির যে কলুষিত মই বেয়ে স্বয়ং তাঁর সাবলীল ওঠা-পড়া সেখানে তো সুরভিত ‘অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম’ বলতে শুধু ‘ক্ষমতা’ সুতরাং অন্য রকম কিছু বুঝে ওঠা তার পক্ষে সম্ভবও নয়। তাঁর প্রশান্ত কিশোর বা অন্যান্য বিশ্বস্ত বিশ্ববিশ্রুত পরামর্শদাতাগণ তাঁকে পাখি পড়া করে বুঝিয়েছিলেন করোনা-টরোনা এ আর এমনকি! দু’দিন থাকবে তিন দিনের দিন সব চলে যাবে। একটু কষ্ট স্বীকার করে দরদী মুখ্যমন্ত্রী নাদান রাজ্য বাসীকে কয়েকটা দিন একটু চক দিয়ে গোলকাটা,সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া বা মাস্ক পরা শুধু শিখিয়ে দিলেই ব্যাস কেল্লাফতে, সঙ্গে কয়েক কোটি টাকায় একটু আধটু বিজ্ঞাপনের সুরেলা সানাই বাজলে তো কথাই নেই, মাইলেজের গোডাউনে একমাত্র “মা-মাটি-মানুষের” লেবেল আঁটা মালই শুধু ডাঁই হয়ে জমতে থাকবে। বাকি বিরোধীরা সব স্রেফ হাওয়া হয়ে হায় হায় করবে । কিন্তু কি আর করা, “দিকেদিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে”!
ঘটনা সব সময় তো আর মমতা মাখানো মাখনের মতো হয় না, ঘটনারও ঘটবার জন্যে কিছু শর্ত লাগে, চলবার জন্যে কিছু নিয়ম লাগে। অতঃপর অতএব মাননীয়া প্রমাদ গুণলেন। করোনা তান্ডব আগ্রাসী, নাগামহীন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। সত্য, তথ্য এসবই চেপে, সচিবদের অপসারণ (চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ?) করেও তা বাগে আনতে পারলেন না। প্রশাসনের চরম অপদার্থতায় এই রাজ্যে ক্রমশ ব্যাপক ভাবে বাড়তে থাকলো আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুরও সঙ্গে সঙ্গে তূষের আগুনের মতো ধূমায়িত ক্ষোভ ফেটে পড়লো স্বাস্থ্য, পুলিশ, দমকল, খাদ্য প্রতিটি দপ্তরে। এরপর আমফানের পরে পরেইতো স্পষ্ট বোঝাই গেল রাজ্যে কোনো সরকারই নেই। সারা রাজ্যের মানুষ যেন এক নেই রাজ্যের বাসিন্দা। ক্ষোদ রাজ্যের রাজধানী শহর কলকাতা টানা চারদিন ধরে, কোথাও কোথাও এক সপ্তাহ অন্ধকার, পানীয় জলের হাহাকার,রাস্তায় সারি সারি গাছ পড়ে আছে তো আছেই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে বিক্ষুব্ধ মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা অবরোধে- কিন্তু প্রশাসন? সরকার? নেই, নেই এবং নেই। তাহলে সব চাইতে বিধ্বস্ত উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার অবস্থা কি একবার কল্পনা করলে ভয়ে শিউরে উঠতে হয় না ?
কিন্তু যাক, থাক সে কথা, আসলে যে কথা বলছিলাম তা হলো বেপথু দিশাহারা, হৃদয়হীন মুখ্যমন্ত্রীর, চতুর মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ এই হুমকির কারন কী ? এর গুরুত্বই বা কী ? যা কিনা আমাদের মনযোগী আলোচনাযোগ্য বিষয়? ‘আত্মসন্মানবোধ’(?) ও ‘মর্যাদাবোধ’(?) সম্পন্ন বাজারি হলুদ সাংবাদিকতার শকুনের কেবল ভাগার অন্বেষণের গভীর অনুসদ্ধিৎসায় সন্মানের সঙ্গে ‘আত্মা’(ব্যাপক অর্থে) বেচার গর্বিত ও বিরামহীন ব্যস্ততার মাঝে ‘গুরত্বহীন’ গণশক্তি’র (যে ‘গণশক্তি’ কে মহামান্য উচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আইনত প্রাপ্য একটাও সরকারী বিজ্ঞাপন দেন না, ‘তেলের লুচি পেলেই বাঁচি’ গোছের উচ্ছিষ্টভোগী উন্নাসিক বিদগ্ধজনেরা যাকে সংবাদপত্র বলেই মনে করেন না, আর দিদির হাতে ফোঁটা নেওয়া ভাইরা যে কাগজ বিক্রীতে ভয় পান) পাতায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রির এই স্বভাবসিদ্ধ হুমকি বা নিষেধাজ্ঞা যাই বলুন না কেন তা আসলে বামপন্থীদের কাছে একটা স্বীকৃতি। তা সে ভয় থেকে হোক বা গদি হারানোর আতঙ্ক থেকে। সেই লকডাউন পর্ব থেকে আমফানে বিধবস্ত বাংলা—দুর্গত মানুষের পাশে বিরোধীরাই বিশেষকরে বামপন্থীরাই। দুর্গত মানুষের রেশন লুঠ করা ছাড়া দল হিসাবে শাসকদল তৃণমূল এই সময়ে কোথাও নেই। বামপন্থীদের শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, যুব, ছাত্র,শিক্ষক, কর্মচারী, সাংস্কৃতিক কর্মী প্রতিটি সংগঠনের প্রত্যেক নেতা থেকে কর্মী সকলের বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয় তরুণদের ভূমিকা যাঁরা গত প্রায় তিনমাস ধরে এই রাজ্যের সর্বত্র যেভাবে মানুষের পাশে থাকার,দুর্গত, অসহায় মানুষের হাত ধরার যে আন্তরিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন , এখনো করে চলেছেন তা বশংবদ কাগজ লিখুক আর নাই লিখুক বয়েই গেল মানুষের মন থেকে তা কোনদিন মুছে যাওয়ার নয়। বামপন্থী নেতা, কর্মীদের মানবিক মূল্যবোধের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা, কর্মপ্রয়াস কোনো সন্দেহ নেই সাম্প্রতিক অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বামপন্থীদের সঙ্গে মানুষের বিশেষত গরিব নিরন্ন মানুষের চিরায়ত আত্মীয়তার বন্ধনকে আরো মজবুত করেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ যে এই রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকরা অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে নিজের ভিটেতে ফিরছেন, ফিরতে পারছেন কেউ অস্বীকার করতে পারবেন যে, সিআইটিইউ’র, বামপন্থীদের নিরন্তর চেষ্টাতেই তা সম্ভবপর হয়েছে ? মুখ্যমন্ত্রীতো পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে আসা ট্রেনকে করোনা স্পেশাল বলে অমুখ্যমন্ত্রী সুলভ তো বটেই সভ্যতার লেশমাত্রহীন ভাবে কটাক্ষ করতেও ছাড়েন নি। আজ পরিযায়ী শ্রমিকরা, করোনা আক্রান্ত মানুষ ও তার পরিবার, লকডাউনে কাজ হারানো নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত মানুষ, আমফান ঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষ কেউই কিন্তু মনে করেন না যে এটা তাদের সরকার, বরং তাঁরা মনে করেন দেশের মতো রাজ্যেরও এই সরকার আসলে লুঠেরাদের সরকার, ভন্ড, প্রতারক। হাত পা ছুড়ে শিল্পের পর্যায় ভুক্ত নির্ভেজাল মিথ্যাচার দিয়ে তাকে আর আড়াল করা সম্ভব নয়, না প্রধানমন্ত্রীর না মুখ্যমন্ত্রীর ।
জীবনের অভিজ্ঞতায় সহজ সরল গরিব মানুষের এই বিশ্বাস আজ আরো দৃঢ় হয়েছে যে, এই চরম দুর্দিনে বামপন্থীরাই তাদের প্রকৃত বন্ধু, এবং পরমাত্মীয়। আর এতেই খুব ভয় পেয়েছেন মুখমন্ত্রী, এতকিছু “জয়” করার পরেও। তারই কদর্য প্রকাশ এই হুমকি এই ফরমান । “ সরকার ছাড়া কেউ ত্রাণ দিতে পারবে না”—অতএব এটা বামপন্থীদের কাছে, বিরোধীদের কাছে এবং সর্বোপরি এই রাজ্যের সমগ্র মানুষের কাছে নৈতিক ভাবে গো হারা হেরে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বীকৃতি নয় ?
———————
![](https://chintannews.com/wp-content/uploads/2020/06/IMG_20200605_085808.jpg)