শান্তনু বোস,নিজস্ব প্রতিবেদন: চিন্তন নিউজ:৮ই জুলাই:– আজ যারা মধ্য চল্লিশের, তাদের বেড়ে ওঠার সময়কালটা পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর সময়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার তখন প্রতিষ্ঠান। আমরা যখন স্কুল পেড়িয়ে কলেজে, আমরা যখন তারুণ্যে, অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া উঠেছিলো। গঙ্গার ধারের সবকটি পৌরসভা বামফ্রন্টের হাতছাড়া হল। আমাদের বন্ধুদের অনেকেই তারুণ্যের স্বাভাবিক স্বভাবেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেসের বা পরে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে নয়। বোধহয় প্রকাশ্যে ওই দলটার পক্ষে দাঁড়াতে রুচিশীলতায় আটকাতো। তাই অনেকেই তথাকথিত রাজনীতি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বাম বিরোধিতা করতো। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধ শিবিরের বলার মতো কথা জোগাতো আনন্দ বাজার পত্রিকা গোষ্ঠী এবং তার কিছু স্মার্ট সাংবাদিক। প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়া, শিল্পায়নে ব্যর্থতা, ওদের ভাষায় কম্পিউটার বিরোধিতা ( অটোমেশন বিরোধিতার সাথে গুলিয়ে দিয়ে) ইত্যাদি ছিল তাদের বিষয়। কিন্তু ভূমিসংস্কার, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া, শ্রমিক কৃষকের অধিকার রক্ষা, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা এই গুলো দিয়ে আমরা যারা বামফ্রন্ট পক্ষে, তারা ছক্কা হাঁকাতাম। সব তর্কবিতর্ক একটা জায়গায় এসে কিস্তিমাৎ করে দিতাম, “তোদের মুখ্যমন্ত্রী কে হবে?”
নাহ্, প্রকাশ্য বাম বিরোধী বা রাজনীতি নিরপেক্ষতার অন্তরালে থাকা বাম বিরোধীদের আর কোনো উত্তর থাকতো না। কথাটা যে কতোটা সঠিক ছিল তা এখন হাড়েমজ্জায় টের পাওয়া যাচ্ছে। আনপ্যারালাল লিডার কথাটা মনেহয় জ্যোতি বসুর সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০০ সাল এবং ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাজ্যের বহু পৌরসভা, পঞ্চায়েত ছিল বিরোধীদের দখলে। না, কোনো প্রলভোন, ভয়, ইত্যাদি দিয়ে বিরোধী শূন্য করার প্রচেষ্ঠা ছিল না। রাজনৈতিক তর্জায় দুর্নীতি নামক বিষয়টা কোনো ইস্যুই ছিল না। রাজনৈতিক বক্তব্যে শালীনতার মাত্রা যে কেউ অতিক্রম করতো না এমনটা নয়। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা কাটার আগেই ভুল স্বীকার করে নেওয়ার রেওয়াজ দেখেছি। গর্ব করে যদি বলতে হয়, আমরা জ্যোতি বসুর পার্টি করি, তাহলে সেই গর্বের ঐতিহ্য বজায় রাখতে ভুল স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া উপায় কি? ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে স্বজনপোষণ কি একদমই ছিল না? না, তা কখনোই নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে থাকবে আর সেই গণতন্ত্রের দুর্বলতার শিকার হবে না, তা হতে পারে না। তবে সেই সময়ে দুধে জল মেশানোর সাথে এখনকার জল সর্বস্বতার কোনো তুলনা চলে না।
একটা সময়ে গোটা দেশ বাজপেয়ী বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করলো। কংগ্রেসের পক্ষেও সুস্পষ্ট জনমত নেই। আঞ্চলিক দল গুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলো। ভারতবর্ষে এলো জোট রাজনীতির যুগ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বজন সম্মত হয়ে যে ব্যক্তির নাম উঠে এলো সেই নামটা হল জ্যোতি বসু। জোট রাজনীতির কারিগর, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিজেপিকে প্রকাশ্যে বলতে পারতেন ” অসভ্য বর্বরের দল”। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সাথে মুখোমুখি সাক্ষাতে যখন বাজপেয়ী জিগ্যেস করলেন এই অসভ্য বর্বর শব্দবন্ধ ব্যবহার প্রসঙ্গে, তখন চোখে চোখ রেখে বলে ছিলেন
” আপনিই বলে দিন কি বলবো। বাবরি মসজিদ ভেঙে দিলেন। দেশ জুড়ে দাঙ্গা হল। আপনাদের আর কি বলা যায়?”
নাহ্, এখনকার দু’জনের সাথে সেই সময়ের দু’জনের তুলনা করবো না। সেটা করা মানে নিজের রাজনৈতিক কালচারের অবমাননা করা।
চুরাশি সালে দেশ জুড়ে শিখ দাঙ্গা আমাদের দেশ দেখেছে কিন্তু আমাদে প্রজন্ম দেখেনি কারণ আমরা তো জ্যোতি বসুর সময়ে বড় হয়েছি। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেশ জুড়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা আমাদের দেশ দেখেছে, কিন্তু আমাদের প্রজন্ম দেখেনি কারণ আমারা তো জ্যোতি বসুর সময়ে বড় হয়েছি। এখন সবাই মিলে ভাবার সময়টা পেরিয়ে গেছে। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। আরেকবার ফিরে আসুক জ্যোতি বসুর সময়টা, জ্যোতি বসুর পার্টির উত্তরাধিকারের হাত ধরে। একটা প্রজন্ম তো শেষ হয়ে গেছে। তারপরের প্রজন্মটাকে বাঁচানোটা ভীষণ ভাবে দরকার। শত জ্যোতি বসু জন্ম নিক। আবার যেন গর্বের সাথে সবাই বলতে পারে ” আমরা জ্যোতি বসুর উত্তরাধিকার বহন করছি”।