কলমের খোঁচা

আমরা আছি কমরেড, আমরা আছি — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:২৪শে এপ্রিল:- “আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা / লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে—/গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে আমার শরীরে, তার/ সবটুকুতেই শস্য যেন ফলে। / কঠিন মাটির ছোঁয়া বাতাস পেয়েছি এই সমস্ত দিন—/নীচে কি তার একটুও নয় ভিজে ?/ ছড়িয়ে দেব দু-হাতে তার প্রাণাঞ্জলি বসুন্ধরা,/ যেটুকু পাই প্রাণে দিশা নিজে।…”(কবর- শঙ্খ ঘোষ)

“আমি কুশমোড় থেকে আব্দুল কাদের বলছি দাদা।” জেলা বীরভূমের প্রান্তসীমায় ব্লক পাইকর,তারও এক প্রান্তসীমায় অবস্থিত গ্রাম কুশমোড়। “পেট বলেছে পেটের টানেই বাইরে আমার যাওয়া, /নিত্যদিনের অঙ্ক কষে, দিন আনা দিন খাওয়া” এই রকমই একজন মাটির মানুষ আব্দুল কাদের, এই কুশমোড়েরই স্থায়ী বাসিন্দা। সব সময় কিছু করার জন্যে পা বাড়িয়ে বা ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে থাকা প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মাটির মানুষ এই আব্দুল কাদের।যেন দারিদ্র তারে করেছে মহান। না,বড়দরের কোনো নেতা তিনি নন। প্রত্যাশার অলীকসুখ কাকে বলে তা তিনি জানেন না, তাঁর নিজের অভাব-অনটন যে আছে তা বিলক্ষণ কিন্তু তা তাঁকে বিচলিত করে না, মান-অভিমান তাঁকে স্পর্শ করে না।“কি পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী”এই যেন তার সহজাত অবস্থান। গত পঞ্চায়েত ভোটে পার্টির পক্ষে নমিনেশন দিতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ ৪৫ দিন জেল খেটে আসার পরেও দ্বিধায় বা ভীরুতায় এতটুকু পিছিয়ে যাওয়াকে তিনি ঘৃণা করেছেন বরং তারপর থেকেই মধ্যদিনের তেজদীপ্ত সূর্যের প্রতিভাষে তাঁর মুখের বলিরেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, “এ আমার অহংকার,/ অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে”। দৈনন্দিন আলোচনার কেন্দ্রে স্থান না পাওয়া বা না চাওয়া নিতান্তই সাধারণ, আটপৌরে একজন রাজনৈতিক কর্মী তিনি- আব্দুল কাদের। শুধু লোহাপুর থেকে সিউড়ী চুরাশি কিলোমিটার পায়ে হেঁটে লঙমার্চ বা নলহাটী থেকে রামপুরহাট পনের কিলোমিটার অক্লেশে সাইকেল যাত্রার মতো জেগে-জাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্লান্তিহীন পথ পরিক্রমায় নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া,বিলিয়ে দেওয়াটাই যেন কেবল তার একমাত্র অভিলাষ । সঙ্গে শুধু একটা বড় লালরঙিন পতাকা হলেই হলো, “বুক জুড়ে যার সোহাগ মাখানো,/ পাহাড় ডিঙিয়ে রাস্তা দেখানো/ লেনিনের হাতুড়ি ও কাস্তে।” ১৬ই এপ্রিল যখন ফোনটা বেজে উঠলো ঘড়িতে তখন ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। “হ্যাঁ, কাদের ভাই বলুন”,এবার কাদের ভাই যথেষ্ট উত্তেজিত, “ কি অনাচার চলছে দাদা, কি আর বলবো। সরকারের দেওয়া রেশনের চাল তুলে নিয়ে ঘাসফুল ওয়ালারা দলের নামে বিলি করছে খুশি মতো। যাদের পাওয়ার কথা তারা তো পাচ্ছেই না উল্টে হরিলুঠ। গরীব মানুষ কিছুই পাচ্ছেনা। আজ সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম দাদা। আমরা গাঁয়ের দরজায় দরজায় ঘুরে টাকা,চাল, আলু সব তুলে বেড়াচ্ছি আর ওরা মানুষের হকের সরকারী চাল,গম কব্জা করে দলের নামে যা খুশি তাই করবে ?গ্রামের লোককে একজোট করে আজ রেশন বিলি বন্ধ করে দিয়ে ছিলাম। বিডিও, থানা সব আসবে ফায়সালা হবে তারপর যা হওয়ার হবে। ওরা এলো,মানলো, বললো, না এটা ঠিক হয়নি, সরকারের জিনিস সরকারী ভাবেই বিলি হবে। ফায়সালা হলো তারপর আবার চালু হলো। গ্রামের সব লোক একমত কমরেড, ভোট লুঠের মতো এই সময় রেশন লুঠ চলবে না, করতে দেবো না।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন কাদের ভাই। “ লকডাউন মেনেই যা করার করছেন তো ? মাস্ক পড়ছেন তো ? ” আমার জিজ্ঞাসায় এবার অনেকটা শান্ত কমরেড আব্দুল কাদের। “ হ্যাঁ কমরেড পার্টি যা বলেছে সব নির্দেশ মেনেই যা করার করছি। কাল নুরুলভাই (পার্টির পাইকর এরিয়া কমিটির সম্পাদক) কে ফোন করে ছিলাম, নুরুল ভাই বললেন, “বিধি, নিষেধ মেনে যতটা পারো এই সময় মানুষের পাশে থাকো। বুঝতেতো পারছো সময় বড়ো খারাপ। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের বড়ো কষ্ট।এইসময় মানুষের পাশে আমরা যদি না থাকি তাহলে আর কে থাকবে বলো।” ? “ভালো থাকবেন কমরেড”- আমার পোশাকি সম্ভাষণে ফোন ছাড়ার আগে মনে বড়ো ভরসা দিয়ে আবার বললেন কাদের ভাই, “আমরা আছি কমরেড, আমরা আছি। ” তারপর থেকেই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে কাদের ভাইয়ের ওই একটা কথা,“ আমরা আছি কমরেড। ”

কথাটা মনে আসছে আর ভাবছি, “একি গভীর বাণী এলো, ঘন মেঘের আড়াল ধ’রে/ সকল আকাশ আকুল ক’রে/ সেই বাণীর পরশ লাগে, নবীন প্রাণের বাণী জাগে/ হঠাৎ দিকে দিগন্তরে ধরার হৃদয় ওঠে ভরে…”। এতো হঠাৎ খেয়ালে বলে দেওয়া, বারবার ব্যবহারে ক্লীশে হয়ে যাওয়া নিছক কোনো শব্দ বা বাক্য নয়! এতো যেন “…বেজে উঠলো এক দুর্বার উচ্চারণ/ এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি—/ প্রাণ আছে,এখনো প্রাণ আছে/ প্রাণ থাকলেই স্থান আছে,মান আছে/ সমস্ত বাধা-নিষেধের বাইরেও / আছে অস্তিত্বের অধিকার”। অজানা শত্রুর হতচকিত হামলায় বিশ্ব যখন ঘরবন্দী, স্তব্ধ বর্তমান, অনিশ্চিত ভবিষ্যত,যখন এ রাজ্যের মানুষের বিশেষত গরীবগুর্ব মানুষের চরম অসহায়তাকে উপহাস করে, সত্যিকে খুন করে,কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের বাহারে চরম অপদার্থতাকে পর্দানসিন করে অতীত বিস্মৃত, শিড়দাঁড়া বিক্রী করা চাটুকার, স্বঘোষিত সবজান্তা, বশংবদ সরিসৃপ সমবিব্যাহারে অশ্লীল কুনাট্যের অহরহ রাষ্ট্রীয় উপস্থাপনায় আরো কলুষিত হয়ে উঠছে স্তব্ধ সমাজদেহ তখন “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন”এ রাজ্যের, রাঙামাটির এই বীরভূমের মাঠ-পাথার-বন্দরে, গলি থেকে রাজপথে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি, “আমরা আছি কমরেড, আমরা আছি”-এ যেন অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর সন্ধানে নয়া ইতিহাস রচনার সেই পটভূমি, দিগন্ত কাঁপিয়ে যেখানে ধ্বনিত হচ্ছে, “ ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান, প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল/ কমরেড লেনিনের আহ্বান, চলে মুক্তি সেনাদল…”।

এ যেন অগ্রগামী সমাজ চেতনার অনাবিস্কৃত উপকরণের অদৃশ্যপূর্ব আবরণ উন্মোচন। ডিওয়াইএফআই,এসএফআই—“রোখা মেজাজ,ঠোকা কপাল” ছন্নছাড়া কটা বেকার ছোকরা অসীম সাহসের সজ্ঞা আমূল বদলে দিয়ে বলে কিনা, “লকডাউনে ভিন রাজ্যে বন্দী পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারের ভার এখন থেকে আমাদের কাঁধে”, “অমুক গ্রামের কাজ হারানো উদভ্রান্ত নিরন্ন আদিবাসী মহল্লার ভার আমরা নিলাম”, “ অনলাইনে কোচিং ? আমরা আছি”, “ভোরবেলায় কোনো ক্ষেতমজুর কমরেডের বাড়ী পৌঁছে দিতে হবে সাইকেলে পাঁচ কেজি চাল, আলু অন্য আরো কিছু খাদ্য সামগ্রি?—“কে বলেগো এই প্রভাতে নেই আমি”। আমরা আছি কমরেড। রেশন লুঠের প্রতিবাদ করে জেলে যেতে হবে? শীতলগ্রামের সুজন- আমি ছাত্র, ইমদাদুল- আমি শিক্ষক— প্রস্তুত। “ মুক্ত করো ভয়, /দুরূহ কাজে নিজেরই দিও কঠিন পরিচয়।” শ্রমিক-কৃষক-মহিলা-চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মী- শিক্ষক-সরকারী কর্মচারী-সাংস্কৃতিক যোদ্ধা-জনবিজ্ঞান কর্মী- পার্টি মুখপত্রের সাংবাদিক—এও যেন এক শক্তিশালী চেন ৷ করোনার চেযেও শক্তিশালী।কঠিন এই সময় টাতে হাতে হাত রেখে,বেঁধে বেঁধে থাকার এও যেন এক হার না মানা গাঢ় বন্ধুতা। ভাঙতেই হবে করোনার চেন, কিন্তু তাই বলে জিততে দেওয়া যাবেনা না খেতে পাওয়ার অসহনীয় যন্ত্রণাকে।স্থানচ্যুতির ধারালো নখের থাবা থেকে মুক্ত করে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। আমরা আছি কমরেড, আমরা আছি।
————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।