কলমের খোঁচা

প্রসঙ্গ– হায়দ্রাবাদ এনকাউন্টার.


সুগত ব্যানার্জি: চিন্তন নিউজ:৮ই ডিসেম্বর:–জনরোষ এর সাথে বিচার ব্যবস্থার ঠিক কি কারনে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই সেই প্রসঙ্গে, ছোট একটা গল্প।
 আগের বছর ঠিক এই সময় আসামের ‘কারবি আংলং জেলায় মুম্বাইয়ের প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার নীলোৎপল দাস আর তার বিজনেস পার্টনার অভিজিৎ নাথ কে (তারা ব্যবসার কাজে আসাম গিয়েছিলেন) ছেলে ধরা সন্দেহে, তাদের গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে পুলিশের চোখের সামনেই বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে ব্রুটালি টর্চার করে খুন করা হয়। একদল মানুষ একসঙ্গে ছেলেধরা ধরেছে, ফলে একেবারে হাতে গরম শাস্তি দেওয়াটাই তো সমীচীন কাজ। পুলিশের যুক্তি ছিল গোটা ঘটনায় ব্যপক পরিমাণে পাবলিক ইন্টারেস্ট জড়িত ছিল, প্রচুর প্রচুর মানুষ ইনভল্ব ছিল, ফলে তারা প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও কিছু করার ছিল না। 
হয়তো তারা নীরব দর্শক ছিল বা হয়তো তারাও ঘটনায় মদত দিয়েছে, হয়তো… হয়তো… সেসব প্রসঙ্গ না হয় থাক। এই ঘটনার জন্যে নিশ্চিত ভাবেই তদন্ত হয়, পরে সংশ্লিষ্ট থানার কিছু অফিসারকে ক্লোজ করা হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। যাক যেটা বলার – উপরের এই ঘটনাতেও ব্যপক লোক সমর্থন করেছিল, অনেকে তৃপ্তিও পেয়েছিল নিশ্চিত ভাবেই। এই হচ্ছে আসল বিচার – একথা মনে ভেবেই অনেকে বিজয়ীর হাসি হেসেছিল সেদিন ভি সাইন দেখিয়ে।

কিন্তু আসল ঘটনা টা কি ছিল? অপরাধী কতটা সঠিক শাস্তি পেল? ভুক্তভুগিই বা কতটা স্বস্তি পেল,  সে বিচার করার দায়ও  সাধারণ মানুষের ওপরেই শেষ পর্যন্ত বর্তায় কিন্তু।।আসলে  যারা সাধারণ মানুষ… তারা বেশিরভাগ সময়েই আগে পিছে কিছু না ভেবেই (সেই ভাবে তলিয়ে ভাবার কার‌ও সময় আসলে নেইও) কোনও ইস্যুতে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেয়। যেকোনো কোনও কিছুর সমর্থনে দু’হাত তুলে নাচে, ফলে  আবেগকে কাজে লাগিয়ে কাজ হাসিল করার উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। এর সাথে বর্তমান সময়ে সুকৌশলে মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনও ভিন্ন মত না শুনে সেই মত যে বা যারা দিচ্ছে তাদের চৌরাস্তার মড়ে দাঁঁড় করিয়ে, গুষ্টি উদ্ধারের পর, ছাল ছাড়িয়ে নেবার মত অদ্ভুত এক প্রকারের হিংস্র ক্ষমতা। তবু তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া যাক, যে দেশের প্রায় সব মানুষ প্রতিবারের মত এবারেও “ধর্ষক”দের চরম শাস্তিই চেয়েছিল। আসলে ধরে নেওয়া টা সত্যি ভুল। হ্যা চেয়েছিলই, দয়া করে মন দিয়ে আবার পড়ুন, বেশিরভাগ মানুষের আসল উদ্দেশ্য কিন্তু “ধর্ষক”দের উচিৎ শিক্ষা দেওয়া। এই পচে যাওয়া গোটা ব্যবস্থা টার বদল করা… । অনেকেই চেয়েছেন ভীষণ ভাবেই, যে অন্তত এই বারের ঘটনা তে যারা “প্রকৃত দোষী” তাদের প্রকাশ্য দিবালোকে চরম তম শাস্তি দিক  বিচার ব্যবস্থা, অন্তত এই ঘটনায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক  আইন সভা।।  কিন্তু কোনও ঘটনায় বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীর শাস্তি, আর সাধারণ মানুষের গণধোলাই দিয়ে কাউকে মেরে ফেলা, দুটো ঘটনা নিশ্চিত ভাবেই এক নয়। কখনই হতে পারে না, অন্ধ আবেগ কে কাজে লাগিয়ে কাজ হাসিল করার উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে।

ইদানিং সময়ের “ধর্ষণ” সহ যতরকমের ঘৃণ্য নারকীয় অপরাধের চর্চিত ঘটনা  সামনে এসেছে, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, পুলিশ প্রাথমিক ভাবে যাদের ধরেছে হয় তারা অপরাধী আদপে নয়, বা মূল অপরাধী আসলে অন্য কেউ। এর মধ্যে অপরাধী যদি প্রভাবশালী হয় তাহলে তো ষোল কলা পূর্ণ হয়ে যায়। যেকোনো ঘটনা, যেটা খুব তাড়াতাড়ি সেটেল করার দরকার হয়ে পড়ে তার ব্যাখ্যা যে আদপে খুব একটা সরল হতে পারে না এটা আজকের দিনে আর কারুর কাউকে শিখিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়েনা। আসলে  সকলেই ভীষণ ভাবে নাটক পছন্দ করে। রাস্তায় একজন মানুষের আক্সিডেন্ট হলে যত না মানুষ দাঁড়ান, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ দাঁড়ান প্রেমিক – প্রেমিকাকে নীতিপুলিশ ধরলে বা নিদেন পক্ষে একটা পকেট মার ধরা পড়লে, সুযোগ এবং সুবিধে থাকলে দুটো লাথি মেরে নেওয়াতে বিরাট বড় বীরত্বের প্রমান ও রেখে যান কেউ কেউ। কিন্তু বুঝে নেওয়ার দায়,  – , সবার রয়েছে বৈকি যে একসাথে একাধিক নাটক চলছে,  ফলে নাটক–নাটক আর নাটকের মধ্যে আপনি নিজেই কখন দর্শক আসন থেকে উঠে, সাইড চরিত্র করতে করতে ভিলেন এর চরিত্রে কাস্ট হয়ে গেলেন সেটা আপনি ধরতে পারার আগেই খেল খতম পয়সা হজম হয়ে যাবে। কিছু না বুঝে, একে তাকে অ্যান্টি ন্যাশানাল, অমুকের দালাল, তমুকের সমর্থনকারী বলে, 
আজ যে বন্দুকের নলকে সমর্থন জানাচ্ছে, ফুল মালা দিয়ে, কাল সেটা তার দিকেই ঘুরে গেলে সামলাবেন কিকরে? তখন কিন্তু সেমসাইড করার চান্স  দলের ৯০% সহ খেলোয়াড়েরই।। আর পুলিশের প্রসঙ্গে “বেড়ালকে পিটিয়ে পিটিয়ে বাঘ বলে স্বীকার করানোর” উদাহরণ এই দেশে দেওয়া, ওই চপ মুড়ি খাওয়ার মতই সোজা। চাইলেই ১..২… করে লিখে দেওয়া যায় বেশ কয়েকটা… আবার উল্টো দিক থেকে অপরাধীকে নিরপরাধ সাজানোর ক্ষেত্রেও এই লেভেলের এক্সপার্ট  আর পাওয়া যাবে কি?
 তবে জানানো প্রয়োজন ঠিক এই সব কারনেই পুলিশের কাছে দেওয়া কোনও জবানবন্দী কোর্টে চলেনা। জবানবন্দী নিতে হলে সেটা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই নিতে হয়। হতে পারে এর অনেক কুফল আছে, কিন্তু সুফলও আছে বৈকি। নইলে তো আর কোনও বিচারক, উকিল, আদালতের প্রয়োজনই থাকতো না। তাই না? এবারে ট্রায়াল বা বিচারের আগে যেকোনো সাসপেক্টকে মেরে ফেলার মানে আপনি কিভাবে আর কি করবেন সেটা সম্পূর্ণ ভাবেই আপনার বোধ বুদ্ধির ওপরেই নির্ভর করবে শেষ অবধি। এতে প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পেলে, নির্যাতিতা ন্যায় বিচার পেলে সবার শান্তি, কিন্তু তারও আগে সব হিসেব গুলো মিলিয়ে দেখে নিতে হবে একবার??পরিশেষে একটা কথা, সবাই নির্ঘাত ইরম শর্মিলা চানু বা আয়রন লেডির নাম শুনেইছেন… উনি বহুবছর “আফস্পা” নামক এক ভয়ঙ্কর অ্যাক্ট এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। আমরণ অনশন করেছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, যখন উনি আমরণ অনশন করছিলেন তখন হাজারে হাজারে মানুষ ওনার সমর্থনে কথা বলতেন…। ওনার পাশে থাকার আশ্বাস দিতেন। তারপর একদিন উনি ভোটে দাঁড়ালেন………. এবং ৯০ টা ভোট পেয়ে ইতিহাস হয়ে গেলেন, ।  এ দেশের মানুষের সমর্থন বড়‌ই তাৎক্ষণিক।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।