কলমের খোঁচা

তব ভূবনে তব ভবনে মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:২৬শে মে:- “THOUGH THIS BE MADNESS, YET THERE IS METHOD IN IT.” (HAMLET)
—Willim Shakespeare

পরাধীন ভারতবর্ষের শাসক ব্রিটিশ পুলিশ ও গোয়েন্দা শিরমনিদের চিনতে ভুল হয়নি তাকে । দরাজ, গান পাগল,শেকল ছিঁড়ে ছুটে অহরহ বেড়ানো, ধরাবাঁধা নিয়মের সঙ্গে আপাত সম্পর্কহীন,‘বাউন্ডুলে’ তার মধ্যে তাই তারা হ্যামলেটের “ There is a system in his madness.”দেখতে পেয়েছিল। তার গতিবিধি ছিল তাদের প্রতি মুহূর্তের নজরে বন্দী। তারা বুঝেছিল এক ভয়ঙ্কর ঝঞ্ঝা, প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণির প্রতিশব্দ ধূমকেতু—সে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তারমধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন রসোত্তীর্ণ কাব্য প্রতিভার অধিকারী এক পূর্ণাঙ্গ কবির সন্ধান, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের কাছে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ স্ফুলিঙ্গ, দেশবন্ধুর কাছে তিনি ঘুম ভাঙানিয়া চারণ কবি আর দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শ্রমিক- কৃষক-তরুণদলকে সংঘবদ্ধ করার কাজে ক্লান্তিহীন সৈনিক তিনি, তার প্রিয়তম মুজফফর আহমদের (ভারতবর্ষে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত কাকাবাবু)’র কাছে সাম্যবাদের ধ্বজা বাহক চির বিদ্রোহী বীর। তিনি আমাদের সবার প্রাণের পরশ, হৃদয়ের প্রশান্তি, ‘বিশ্ব-বিধাত্রীর’ ‘বিদ্রোহী-সূত’, ‘চির উন্নত শির’ কবি নজরুল। আমাদের প্রিয় কবি, আত্মজন কাজী নজরুল ইসলাম।
এমনই একজন অমিত শক্তিধর, অসামান্য শিল্পীর কাব্য প্রতিভাকেও কিন্তু নস্যাত করার, ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টা কম হয়নি সেই সময়। তাও আবার তৎকালের বেশ কয়েকজন নামী খ্যাতিমানের হাত ধরে। সারবস্তুহীন আঘাতে আহত কিন্ত তিনি বিহ্বল নন,তিনি পথভ্রষ্ট নন। নজরুল সেই সময় পরম স্নেহের পরশ সহ পাশে পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বিশ্বকবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথকে। নজরুলের কবিতায় “শুধু হইচই আছে, কবিত্ব নেই” এই ফাঁপা স্থুল সমালোচনায় বা প্রকারান্তরে নিন্দায় মূখর হয়েছিলেন যারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত তাদের এই (অপ) প্রয়াসকে ভোঁতা করার জন্যে কলম হাতে তুলে নিতে হয়েছিল। নজরুলকে প্রতিনিয়ত হেয় করার চেষ্টাকে খারিজ করে তাঁকে লিখতে হয়েছিল,“ আমার বিশ্বাস তোমরা নজরূলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও রূপ ও রসের সন্ধান করনি, কেবল অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।” আজ নজরুলের কালজয়ী “বিদ্রোহী” কবিতা খানির সাতানব্বইতম বর্ষে পদার্পণের সন্ধিক্ষণে শুধুমাত্র তাঁর এই একটি মাত্র কবিতার আজো ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার দিকে দৃষ্টি ফেরালে বুঝতে অসুবিধা হয়না গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের নজরুল মূল্যয়ন কতটা যথার্থ সিদ্ধিলাভে সক্ষম হয়েছিল। আসলে নজরুলের কন্ঠস্বর তো জনগণমনের কন্ঠস্বর, তার জনপ্রিয়তায় তাই শুধুই জোয়ার, ভাটা নেই। হুঁশিয়ার কান্ডারী নজরুলের কবিতা, গান দিশাহারা প্রায় ‘মৃত’ মানুষকে যেভাবে সেদিন জাগিয়ে তুলেছিল, আজো অহরহ সমানভাবে চেতনার অন্দরমহলকে মাতিয়ে রেখেছে ; তা যেন সত্যিই এক বিস্ময়। সুতরাং ব্রাত্যজনের কবি, ‘ কুলি-মজুর’-র কবি নজরুলের কবি প্রতিভার মূল্যয়নের স্পর্ধা না দেখিয়ে আমরা বরং তাঁর ১২২ তম জন্মদিবসে আরেক কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাহিত্য সমালোচক ও প্রিয় জননেতা শ্রদ্ধাস্পদ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কাছে ঋণী হয়ে দ্বিধাহীনভাবে শুধু ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ এইটুকু বলতে পারি সাম্য সাধক কবি কাজী নজরুল ছিলেন, আজো সমানভাবে আছেন আমাদের “হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।” কিন্ত প্রায় সারাটা জীবন নিদারুণ দারিদ্র, পুলিশের শকুন দৃষ্টি আর হৃদয়হীন ‘খ্যাতিমান’ নিন্দুক সমালোচকদের কটুক্তি এই ত্রিফলা বিষাক্ত আক্রমণের মধ্যেও প্রাণবন্ত লেখনীর অনাবীল ঝর্ণাধারায় বিদ্রোহের শাশ্বত রূপের পরিস্ফুরণ হয়েছিল যার কলম বেয়ে সেই চির বিদ্রোহী ধূমকেতু নজরুল কী শুধুমাত্র কবি ? বিদ্রোহী কবি ? “নজরুলের একটা বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তিনি যুদ্ধের সময় থেকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার সঙ্গে সাম্যবাদকেও অঙ্গাঙ্গীভাবে গ্রহণে উদগ্রীব ছিলেন।”(যুগ সন্ধিক্ষণ গোলাম কুদ্দুস,পৃ ১০১) ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বসে কাজী নজরুল রচনা করেছিলেন আক্ষরিক অর্থেই তার জবানবন্দী “রাজবন্দীর জবানবন্দী” (ভূমিকা- ডঃ রহমান হাবিব)। সেখানে তিনি উদ্যতকন্ঠে যা বলেছেন তাতো তার জীবনবোধেরই স্বার্থক পরিচয়। যেখানে আমরা লক্ষ্য করতে পারি,উপলব্ধি করতে পারি বৃটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের তৎকালিন অবস্থাকে মূল্যয়ন করার ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে। একই সঙ্গে আমাদের দৃশ্যপটে আঁকা হয়ে যায় একজন পূর্ণাঙ্গ পরিপূর্ণ মানুষ নজরুলের চির জাগরুক অবয়ব। — “আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে তা রাজদ্রোহ । কিন্তু এ যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা,অন্যায় কে ন্যায়, দিনকে রাত বানানো—একি সহ্য হতে পারে ? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে ? এতদিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত আত্মা মাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসন ক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কন্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি রাজদ্রোহী ? এ ক্রন্দন কি একা আমার ? না এ আমার কন্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল নীরব ক্রন্দসীর সম্মিলিত সরব প্রকাশ ? আমি জানি আমার কন্ঠের ঐ প্রলয়-হুঙ্কার একা আমার নয়, সে যে নিখিল আত্মার যন্ত্রণা চিৎকার। আমায় ভয় দেখিয়ে মেরে এ ক্রন্দন থামানো যাবে না। হঠাৎ কখন আমার কন্ঠের এই হারাবাণীটিই আর একজনের কন্ঠে গর্জন করে উঠবে।”(পৃঃ৬৪)। এর পরেই ব্রিটিশ জেলে রাজবন্দীদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল জেলের মধ্যেই অনশন ধর্মঘট শুরু করেন যা চলেছিল ৩৯ দিন। জেলবন্দী নজরুলের এই অনশন ধর্মঘট সেদিন জেলের বাইরে অসংখ্য মানুষের মনকে ‘জন্মগত অধিকার’ স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করার শানিত চেতনাকে যেভাবে উদ্বেলিত করে তুলেছিল বিশেষকরে যৌবনকে যেভাবে একাধারে উদ্বিগ্ন ও উত্তাল করেছিল তাতেই বোঝা যায় কে ছিলেন নজরুল, কেমন ছিলেন নজরুল, কাদের হৃদয়ের সবটাই দখল করে ছিলেন কাজী নজরুল। “… আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তম্বী-নয়নে বহ্নি, / আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্যাম, আমি ধন্যি!— / আমি উন্মন মন উদাসীর, / আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর! / আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের, / আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের!…” আবার তার একটু পরেই তিনি বলছেন, “… মহা-বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত / আমি সেই দিন হব শান্ত / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, / অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—/ বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত / আমি সেই দিন হব শান্ত!…“ তাহলে এটা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধার হওয়ার কথা নয় যে, নজরুল কেবলমাত্র বিদ্রোহী কবি ছিলেন না, ছিলেন বিদ্রোহের সক্রিয় স্বপ্নালু সংগঠকও। অতএব “নজরুলের বিদ্রোহ সংকীর্ণ বিদ্রোহ নয়, বরং সর্বাত্মক বিদ্রোহ। নজরুলের শিল্প সাহিত্য তাই চিরায়ত সাহিত্য। নজরুলের বিদ্রোহ তারই শাশ্বত রূপ।“(যূগ সন্ধিক্ষণ-গোলাম কুদ্দুস, পৃঃ৯৬)। পরাধীন ভারতবর্ষে সেদিনের ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ নজরুলের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তিনি যৌবনকে ডাক দিয়ে ছিলেন, “… ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত / আমরা আনিব রাঙা প্রভাত, / আমরা টুটাব তিমির রাত, / বাধার বিন্ধ্যাচল। / নব নবীনের গাহিয়া গান / সজীব করিব মহাশ্মশান, / আমরা দানিব নতুন প্রাণ / বাহুতে নতুন বল…” সেদিনের যে সামন্তবাদী শোষণের স্বরূপ এবং চিন্তাধারা নজরুলকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল, অস্থির তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন,“আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, / মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, / আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর।/ আমি দুর্বার, / আমি ভেঙে করি সব চুরমার! / আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল, / আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!” আবার সেদিনের সাম্প্রদায়িকতার বিষ দহনে উদভ্রান্ত সমাজ নজরুলকে যখন পরিত্রাতার ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিল তিনি ডাক দিয়েছিলেন,“ অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ, / কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ! / “ হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? / কান্ডারী বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!” আমরা কি করে ভুলে যেতে পারি আজ সেই সমাজ বাস্তবতা আরো সর্বনাশা রূপ ধরেছে। আজকের বিশ্বে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ যদিও বেপথু তবুও ক্ষুধার্ত হায়নার হিংস্রতায় আর লুঠের লাম্পট্য নিয়ে বিরাজমান,মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তো এত ধাক্কা খেয়েও অবশিষ্ট বিশ্বকে আজো স্বীয় জমিদারীর প্রজা বলে ভাবতে জুরি নেই। সামন্তবাদবাদের যাবতীয় পশ্চাৎপদ নষ্টামি, পুতিগন্ধময় উপাদানে পরিপূর্ণ আজ সেদিনের তুলনায় অধিকতর পুঁজিবাজ-সাম্রাজ্যবাদ আশ্রিত ও সমর্থনপুষ্ট হয়ে সাম্প্রদায়িকতা আজকে আমাদের জাতীয় জীবনে প্রধান রাষ্ট্রীয় শক্তি। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা,যুক্তি-তক্কের মেলবন্ধন, মানবিক মূল্যবোধ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে এই আসুরিক শক্তির অবস্থান। তাই সেদিনের মতো আজ বরং আরো বেশি করে শিরদাঁড়া সোজা করে সংঘবদ্ধ হওয়ার, জেগে ওঠার, জাগিয়ে তোলার আর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিরামহীন প্রজ্ঞার প্রয়োজন আর তাই আমাদের চেতনায় চাই নজরুলের উজ্জ্বল উপস্তিতি। নজরুলের ১২২ জন্মদিবসে আজ তার প্রতি আমাদের হৃদয় নিংড়ান শ্রদ্ধা নিবেদনে বিশ্বকবির কাছে আমাদের হাত পাতা বোধহয় কোনো বিচ্যুতি হবে না, কারন তিনি তো ছিলেন নজরুলের প্রিয়, প্রিয়তম বিশ্বকবিসম্রাট । “ প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে / মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। / তব ভূবনে তব ভবনে / মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান। ”
——————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।