কলমের খোঁচা

করোনা” কৃপায় পৃথিবী লকডাউন ময় ক্ষুধা তাই বুঝি নিয়েছে লম্বা ছুটি


সঞ্জীব বর্মণ: চিন্তন নিউজ:৩রা এপ্রিল:- খামোকা লম্বাইবা বলি কেন, সম্ভবত স্থায়ী ভাবেই এই মহাবিশ্ব থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেছে ক্ষুধা। তাকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা নেই, হয়তো হবেইনা আর কোনো দিন। ক্ষুধা ব্যাপারটা এতটাই অপ্রয়োজনীয়, ফালতু আর মূল্যবান সময় বিনাশকারী যে, আমার – আপনার আলোচনায় বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় আলোচনায় সে যত কম আসে ততই ভালো। আর এখনতো আমাদের এই গ্রহের ৭৮০ কোটি বাসিন্দার একটাই শত্রু-ভাইরাস করোনা। কে জানেনা বলতে পারেন যে, এই বিধ্বংসী শত্রুর মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী অনুমোদিত এবং ঘোষিত অস্ত্রও এখন একটাই-‘লকডাউন’।কারুর জানতে বাকি আছে কী যে,এই অস্ত্র প্রয়োগের বিশ্বজোড়া ঘোষিত অলঙ্ঘনীয় শর্তও সেই একটাই- দেশ, জাতির সীমানা ছাড়িয়ে, সব বাদ-বিসম্বাদ দু’পায়ে মাড়িয়ে এখন চাই বিশ্ববাসীর সার্বিক ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য।

কোনো কোনো নিতান্ত বেরসিক এই চরম দুরূহ পরিস্তিতেও রসিকতা করে বলেছন, এই পৃথিবী যদি হয়এক এবং একমাত্রহোস্ট সেল (host cell) তাহলে সুসভ্য (?) এবং শ্রেষ্ঠ(তাই কী ?) জীব মানুষ হলো এই গ্রহে অনধিকার প্রবেশ ও রাজত্বকারী এক ভয়ঙ্কর মারণ জীবাণু আর ‘করোনা’ তার এন্টিবডি( antibody)। আধিপত্য করার সুযোগ পেয়ে এই এক এবং একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহটার ওপর, গ্রহের বাকী অন্যান্য বাসিন্দাদের ওপর মানুষ যে অত্যাচার দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগের যুগ যুগ ধরে করে চলেছে কোনো না কোনো সময়ে তার প্রতিশোধ তো ভূলোক নেবেই। ‘করোনা’ হয়তো কিছুদিন পর চলে যাবে কিন্তু আবার কিছু আসবেই। বসুন্ধরা এবার নিজেকে মানুষ নামক হিংস্র, ধ্বংসাত্মক জীবের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যে তার তূণের সব অস্ত্রেই শান দিয়ে রাখবে। খুব হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির অজুহাতে মানুষের অত্যাচার সহ্য করতে সে আর প্রস্তুত নয়। যাক সে কথা, ভুললে চলবেনা প্রসঙ্গহীন রসসীক্ত রসিকতার সময় এটা নয়। ঠিক যেমন ক্ষুধা, দারিদ্র বারবার আলোচনায় ক্লীশে হয়ে যাওয়া শব্দ গুলো নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করারও সময় এটা নয়। এখন সময় শুধু বিশেষজ্ঞ দের, রাষ্ট্রীয় অভিভাবক দের কথা শুনে চলা, এবং অবশ্যই মেনে চলা,—‘ঘড়ে থাকুন, লকডাউন মেনে চলুন’।

যাক, যে কথা বলার ছিল, বিশ্বব্যাপী তান্ডব চালিয়ে ফেরা করোনার ছোবল মোকাবিলায় ‘লকডাউন’ অস্ত্র হাতে অতএব এখন আমাদের চাই দুনিয়া জোড়া সব মানুষের আঁটোসাঁটো ঐক্য। মানে, সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ঐক্য সেই ঐক্য। এই যেমন ধরুন, আপনার সঙ্গে আমার ঐক্য, বামের সঙ্গে দক্ষিণের আর অতি দক্ষিণের সঙ্গে অতি বামের ঐক্য, ট্রাম্পের সঙ্গে আমাদের প্রধানের আর আমাদের প্রধানের সঙ্গে আমাদের মুখ্যর ঐক্য, পুঁজির সঙ্গে শ্রমের ঐক্য, দারিদ্রের সঙ্গে বৈভবের ঐক্য, ,সব হারার সঙ্গে সব পাওয়ার ঐক্য, শিকারীর সঙ্গে শিকারের ঐক্য, মজুরি না দেওয়া বা কম দেওয়ার সঙ্গে মজুরি না চাওয়া বা কম মজুরি মেনে নেওয়ার ঐক্য, ছাঁটাই করার সঙ্গে ছাঁটাই হওয়ার ঐক্য, পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজনে আগুনের লেলিহান শিখার সঙ্গে সেই শিখায় জ্বলতে থাকা বন্যপ্রাণের ঐক্য, ব্যারিকেড ভাঙা মিছিলের সঙ্গে মিছিল ভাঙা জলকামানের ঐক্য, দরিদ্রের সঙ্গে দারিদ্রের ঐক্য,খেতে না পাওয়ার সঙ্গে গোগ্রাসে খাওয়ার ঐক্য,সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সঙ্গে অবিচারের ঐক্য, হনুমানের সঙ্গে মানুষের ঐক্য ইত্যাদি, প্রভৃতি। অতএব লেগে পড়ুন মেনে চলার দায়িত্ব পালনে।

স্যানিটাইজার নেইতো কি হয়েছে সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুয়ে, মুখোশে মুখ ঢেকে (সব রকম মুখোশ এখন আইনসিদ্ধ) লেগে থাকুন- এখন লকডাউন চলছে।মনে রাখবেন, একদিন এই ঝড় থেমে যাবে পৃথিবী আবার শান্ত হবে। কিন্তু বিড়লা সিমেন্টের মতো অটুট মজবুত ঐক্যটা ধরে নিন থেকেই গেল। নতুন করে আবির্ভূত হয়ে জাতির পিতাকে আর সে যুগের বিড়লার মতো এযুগের কোনো আম্বানিকে অর্জিত(?)সম্পদ থেকে গরিবকে কিছু দাক্ষিণ্য দেওয়ার আর্জি জানাতে হবে না।বা লুটেরাদের হাতে লুঠ হওয়া চিটফান্ডের টাকা আদায়ে আর কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে হবে না। বলিপ্রদত্ত গণতন্ত্র ও সংবিধানও হারিকাঠ মুক্ত হবে। অতএব রাষ্ট্রের (এবং রাজ্যের) দোষ ধরতে যাবেন না ভূল করেও।ভরসা রাখুন ‘মেলাবেন তারা মেলাবেন’।পরিযায়ী শ্রমিক বা উদভ্রান্ত পথবাসী কারুর কথা আপনাকে ভাবতে হবে না, ওসব রাষ্ট্র ভাবছে। আপনার এখন শুধু একটাই মন্ত্র—লকডাউন। মুনিশ্রেষ্ঠ একক্ষণে এবার একটু মৌন হইলেন। অতঃপর এতক্ষণের নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা ভাঙিয়া আরুণি কহিল, “হে ঋষিবর আপনার সুললিত বচনে আমার উপলব্ধির অন্দরমহলের প্রতিটি দরজা হাট করিয়া খুলিয়া গেল, জানালা গুলি তো ভাঙিয়াই গেল একথা স্বীকার করি। তবে কিনা গুরুদেব, ধ্বন্দও রহিয়া গেল গুটিকয়, তপস্বী অনুমতি করিলে কহিতে পারি’। মুনিবরের দ্বিধাগ্রস্ত অনুমতি ক্রমে আরুনি কহিল,—ঋষিবর এই যেমন ধরুন,এই সংকট কালে অতি প্রয়োজনীয়,অতি দুর্লভ এবং বলা নিতান্তই বাহুল্য এত সুগভীর এই “ঐক্যের” পরিমন্ডলে “মুখ্য ভাবেন আমি দেব(পড়ুন দেবী), প্রধান ভাবেন আমি…” এই কুনাটকীয় প্রতিযোগিতার প্রয়োজন পড়ছে কেন? কেউ ঘনঘন ভাষণে দেশবাসীকে পেটে খিলদিয়ে ঘড়ে থাকার নিদান দিচ্ছেন তো কেউ এই রাজ্যের অধিবাসী গণের নিমিত্ত আস্ত কবিতা আঁচলে বেঁধে স্বপারিষদ(বশংবদ সংবাদ সংহারক সহ) সব্জির দোকানে খড়ি দিয়ে বৃত্ত আঁকছেন,তাও আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত বিধিকে থোরাই কেয়ার করে। আমাদের ‘মুখ্য’তো শুনেছি করোনার করাল গ্রাস সামলাতে সবাইকে ডেকে “ …আয় আরো হাতে হাত রেখে, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি…” শঙ্খ বাবুর এই কবিতা আউরে ছিলেন তবে এখন আর কাউকেই তার প্রয়োজন নেই ঠাউরে প্রশাসনকে সর্বস্তরে সক্রিয়, সচল ও আন্তরিক করার বদলে কলকাতার ইতিউতি ব্যক্তি প্রচারের ঢাক বাজিয়ে দায় সারছেন কেন ?হে ঋষি একজন রাজ্য প্রশাসনের প্রধানের পক্ষে নিজেকে আতি চালাক বা ধূর্ত জ্ঞান করে রাজ্যের অবশিষ্ট মানুষকে এতখানি বোকা ভাবা কি করে সম্ভব! নাকি এটাও একটা রোগ! কি ভেবেছেন উনি, একজন কি দুজন যখন যেমন তখন তেমন, সুবিধাভোগী, মুখে খই ফোটানো, খঞ্জনীবাদক চিকিৎসক বা গানওয়ালা বা প্রসাদপ্রাপ্ত, শিরদাঁড়া হীন প্রশাসনিক কর্তা ঢোল বাজালেই প্রচার সর্বস্বতার আড়ালে এই অভূতপূর্ব বিপর্যয় মোকাবিলায় রাজ্যের আসল কঙ্কালসার চেহারাটা ঢাকা পড়বে ? একটু মন দিয়ে এই সময়ে ধৈর্য ধরে অন্যান্য সকলের পরামর্শ যদি আমাদের মুখ্য শুনতেন তাহলে জানতে পারতেন বাজার খেকো মিডিয়ার চোখে না পড়লেও এই দুঃসময়ে সব বিধি যথাযথভাবে মেনেও রাজ্যে, (এবংদেশে) বামপন্থীরা অসহায় মানুষের কাছে থাকার,পাশে থাকার মানবিক মূল্যবোধের অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। রাজ্যের মহল্লায় মহল্লায় বিদ্যুৎ গতিতে গড়ে ওঠা যুব-ছাত্র দের স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ তাদের হেল্প লাইনে সংবাদ পেয়েই পরিযায়ী শ্রমিক দের অসহায় পরিবারের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে মানবিক সহায়তা নিয়ে, বুঝতে পারতেন এর তুলনায় মুখ্যর ছবি বুকে সাঁটিয়ে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঢেকে আমাদের মুখ্যর চ্যালাচামুন্ডারা রাস্তায় যা করছেন তা আসলে অশ্লীলতার প্রতিশব্দ। মনে রাখতে কিন্তু দোষ নেই ,’সত্যি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেই’। শিষ্য নীরব হইলো। ঋষিবর আপাত শান্ত অতিপ্রিয় শিষ্যর সব কথা শুনিলেন এবং ততোধিক নীরব হইয়া তাঁহার চক্ষু যুগল বন্ধ করিলেন। তাঁহার চোখ দুটিকে কেমন যেন সদ্য জাগ্রত আগ্নেয়গিরির মতো মনে হইল।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।