শান্তনু দে: চিন্তন নিউজ:৩রা এপ্রিল:–১. করোনা আসলেই একটি অসাম্যের ভাইরাস। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রত্যেকে। কিন্ত প্রত্যেকের উপর এর প্রভাব সমান না। জনসন আর জগদীশ দু’জনেই আক্রান্ত। কিন্তু দু’জনের উপর প্রভাব এক না। লকডাউনে আম্বানি আর লকডাউনে আলতাফ। দু’জনের দিন কাটছে না একভাবে। শ্রমিকমহল্লা আর ঝাঁ-চকচকে অভিজাতা পাড়ার ছবি এক না।
২. চরিত্রের দিক থেকে অতীতের অর্থনৈতিক সঙ্কটের তুলনায় এই সঙ্কট একেবারেই আলাদা। বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ। এটি কোনও স্বাভাবিক সঙ্কট নয়। করোনার মহামারির প্রভাব একটি ‘অন্য ধরনের সঙ্কট’। এটি নিছক চাহিদার সমস্যা নয়। করোনার সংক্রমণ ব্যাহত করছে বিশ্বায়িত অর্থনীতি এবং সাপ্লাই চেইনকে। কারণ দেশগুলি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের সীমান্তকে। করোনা মোকাবিলায় চলেছে ব্যাপক আকারের লকডাউন ও কোয়ারেন্টাইন। আয় মুখ থুবড়ে পড়ছে বহু মানুষের। রোগের কারণে মানুষ ব্যবসা বন্ধ করছে। মার্কিনমুলুকে, নিউ ইয়র্কে পর্যন্ত রেস্তোরাঁ বন্ধ। বন্ধ ফ্লাইট। বন্ধ হোটেল বুকিং। মানুষ তাঁদের ধার শোধ করতে পারছে না। নতুন করে ধার নিতে পারছে না। ব্যবসা নতুন করে ঋণ নিতে পারছে না। কোনও ব্যাঙ্ক এই ব্যাপক অর্থনৈতিক অধোগতি থেকে রেয়াত পাবে না। যাঁরা সঙ্কটের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবেন, তাঁদের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন— একে বলা যেতে পারে হেলিকপ্টার মানি (কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যখন সরাসরি ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে থাকে)— তাঁদেরকে দিতে হবে, যাঁরা রয়েছেন ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে।
৩. আগামী কয়েকমাসের মধ্যে বেকার হবেন অন্তত আড়াই কোটি মানুষ। শ্রমিকদের সম্মিলিত আয় কমবে ৩ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি ডলার। অসহায় আর্তনাদ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রধানের গলায়। শুধু তাই নয়, উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তিনি বলেছেন, ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, এই তথ্য-ও একেবারে কমিয়ে দেখানো, বাস্তবতা আরও ভয়াবহ হতে পারে।
৪. ভাইরাসের কোনও ভিসা পাসপোর্ট লাগে না। সে কোনও সীমান্ত চেনে না। শোনে না কোনও জাতীয়তাবাদী ভাষণ। বলা যেতে পারে বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিক। আর কোনও সীমান্তপার সঙ্কটের যখন উদ্ভব হয়, তখন তা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কটের মতোই হয়ে ওঠে বিশ্বায়িত বিষয়। মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন হয় বিশ্বায়িত সমন্বিত উদ্যোগ।
৫. নয়া উদারবাদ কাজ করছে না। কাজ করছে না একা বাঁচার দর্শন। ব্যক্তিই মুখ্য এখন বড় বাধা। আমরা বলছি যৌথ প্রয়াসের কথা। প্রতিযোগিতাকে ছাপিয়ে এখন সহযোগিতার কথা। সমন্বয়ের কথা। বাজার জানে না কীভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নেই কোনও অদৃশ্য হাত। এমনকি অভিজাতরাও অনটনের মুখোমুখি। মাস্ক নেই। সুরক্ষা পোশাক, ভেন্টিলেটর নেই। চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত সাড়া দিচ্ছে না বাজার। বাজারের ভক্তদেরও মুখ কেমন শুকনো। বাজার তখনই ঠিক কাজ করে, যখন সবকিছু ঠিকঠাক, স্বাভাবিক। সেই বাজারই ভালো কাজ করে না, যখন সঙ্কট। অর্থনৈতিক সঙ্কটে বাজার দিশেহারা। সব ঝুঁকি নিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্র সব মুনাফা তুলে নিতে পারে, ভেঙে গিয়েছে সেই মিথ-ও।
৬. রেগন শুনিয়েছিলেন ‘সরকার কোনও সমস্যার সমাধান নয়, বরং সরকার নিজেই সমস্যা।’ সব তুলে দাও বাজারের হাতে। সরকার থাকুক স্লিম, স্মার্ট। দেখা যাচ্ছে বাজার মুখ থুবড়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জাতীয়করণের কথা উঠছে, সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবি জোরালো হচ্ছে। চীন কীভাবে সফল হলো, কেন পারছে না ইতালি, স্পেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
৭. চীন প্রথম, সঙ্কট মোকাবিলায় সহায়তার প্রস্তাব প্রথম এসেছে দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে নয়। তিনদশক ধরে চীনকে বলা হচ্ছে ‘ওয়ার্কশপ অব দি ওয়ার্ল্ড’। মহামারি দেখিয়েছে, পশ্চিমের ডাক্তার ও ল্যাবের জন্যও সে নিজেকে তুলে এনেছে। চীনেই প্রথম এই ভাইরাস। সেকারণে, চীনেই প্রথম দেখা যায় এর পরিণতি। কিন্তু, তারপর সে সেই সঙ্কট মোকাবিলা করে খুবই কার্যকরভাবে। জনসংখ্যার তুলায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার একেবারেই সামান্য। চীনে আক্রান্তের সংখ্যা ৮২,০০০। জনসংখ্যার ০.০০৫ শতাংশ মাত্র। দুনিয়ার অন্যত্র এমন হয়নি। চীন দেখিয়েছে, কীভাবে কার্যকরভাবে এই লড়াই লড়তে হয়।
৮. ইউরোপ আর প্রিয়সুহৃদের আয়না নয়। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সামনে থেকে লড়ার প্রশ্নে ভূমিকা— আগে বহুবারের মতো আবারও দুনিয়াকে দেখানোর সুযোগ তারা হারিয়েছে। করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় তারা আদৌ ফলপ্রসূ হতে পারে না। যতটা দেখানো হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল তাদের তথাকথিত জনকল্যাণকর রাষ্ট্র। ইতালি এবং স্পেনের এহেন শোচনীয় অবস্থা। মোটেই কাকতলীয় নয়। তার উপর, গোটা মহাদেশে অন্তত একটি সাধারণ পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেখিয়েছে তাদের দুর্বলতা। গোটা ঘটনা বেআব্রু করেছে, ইউরোপ একটি একক ও অর্থনৈতিক বাজার হলেও, গোটা মহাদেশের জন্য একটি সাধারণ সামাজিক প্রকল্প থেকে ব্রাসেলস বহু দূরে।
৯. স্বাস্থ্যের কথা যদি বলতেই হয়, তবে বলতে হবে কিউবার কথা। যার কেউ নেই, তার কিউবা আছে। ২০০৫, ফিদেল তৈরি করেছিলেন ইন্টারন্যাশনাল কনটিনজেন্ট অব ডক্টরস স্পেশলাইজড ইন ডিজাস্টার সিচুয়েশনস অ্যান্ড সিরিয়াস এপিডেমিকস। এখন যা খুবই জরুরি। স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ আসলে, কিউবা হলো ভূরাজনৈতিক মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্র।