দেশ

পারস্পরিক হিংসা,দ্বেষ, অবিশ্বাস অর্থনীতির ভাঙনের প্রকৃত কারণ,–বললেন অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু।


চৈতালী নন্দী:চিন্তন নিউজ:১৬ই জুন :–সামাজিক বিশ্বাসের অভাবই অর্থনীতির স্বাস্থ্যভঙ্গের প্রকৃত কারন; বললেন বিশ্ব ব‍্যাঙ্কের প্রাক্তন অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু।যে সমাজে মানুষ বাস করছে তার প্রতি বিশ্বাসের বোধের প্রভাব পড়ে অর্থনীতির উপর। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপর সামাজিক বিশ্বাসের যে প্রভাব পড়ছে সেটা সবসময় পরিসংখ্যান দিয়ে ব‍্যাখা করা যায়না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। এ প্রসঙ্গে তিনি ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার উল্লেখ করে বলেন, তিনি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ,সমাজে পারষ্পরিক বিশ্বাস বেশী থাকলে আর্থিক বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশী হয়।মনমোহন সিং বা রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতিবিদরাও একই অভিমত পোষণ করেন। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ে সম্প্রতি দেখা গেছে, কোনো সংস্থার কর্মীরা যদি নিজেদের সংস্থার অঙ্গ বলে মনে করেন,তবে তাদের কাজের উন্নতি হয় ৫৬%,অসুস্থতা জনিত ছুটির সংখ্যা কমে ৭৫%।

তিনি আর‌ও বলেন ১৯৪৭সালে স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের মানুষের মনে এই চেতনা তৈরী হয়েছিল যে সবাই মিলে দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। এই কারণ যে আর্থিক বৃদ্ধি  শুরু হয়,তা অভাবনীয় গতি পেয়েছিল ২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত। তা ছিল এই বিশ্বাস বোধেরই ফল যা বর্তমানে একেবারে তলানিতে এসে পৌঁচেছে। সমগ্র গ্রামীণ ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্র দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্বাসের উপরেই।
দেশের সরকার যদি কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীকে, জাতি বা ধর্মীয় কারণে, সন্দেহের নজরে দেখতে থাকে তবে এই সামাজিক বিশ্বাসের ভয়ংকর ক্ষতি হয়। যা বর্তমানে উত্তরপ্রদেশে ঘটছে।নোটবন্দি বা জিএসটির কথা মাথায় রেখেও তিনি বলেন, আর্থিক বৃদ্ধির অবস্থা এতো খারাপ হবার কারণ ঐ সামাজিক বিশ্বাসে ঘাটতি যা গত শতকের ষাটের দশকের পর দেখা যায়নি।

স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, আর ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব ছিল দেশের সম্পদ। যা  ২০০৩থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতকে সামাজিক বিশ্বাস আর আর্থিক বৃদ্ধির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ‍্যে অন‍্য মর্যাদা দিয়েছিল। এটা খুবই দূর্ভাগ‍্যজনক ,যে ভারত আজ সেই সম্মান ধরে রাখতে ব‍্যার্থ হয়েছে।

যেখানে গণতন্ত্র নেই কিন্তু সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চাপে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির রাশ চলে যায় সরকার ঘনিষ্ঠ বিশেষ শ্রেনীভূক্ত পুঁজিপতিদের হাতে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে ভারতে।এই পুঁজপতি গোষ্ঠী অনেক সময় স্বৈরাচারী শাসকদের ভয়ের দ্বারা পরিচালিত হয়।

বর্তমান ভারতে ভোগব‍্যায় বৃদ্ধির পরিমাণ প্রবল ভাবে হ্রাস পেয়েছে।বিদ‍্যুৎ ব‍্যাবহার বৃদ্ধির হার গত ত্রিশ বছরে সবচেয়ে নীচে। সম্পূর্ণ অর্থনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে হওয়ার দরুণ কয়েকজন লোক পুরো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হয়, এরফলে বাড়ে অসাম‍্য যা এখন সর্বাধিক। প্রায় পাকিস্তানের মতো।
তবে এই অবস্থা থেকে ফিরে আসা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। অর্থনীতিতে মন্দা কাটাতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব‍্যয় প্রসঙ্গে তিনি কেইনসের প্রসক্রিপশনের কথা উল্লেখ করেন। সঠিক ভাবে যদি সরকার টাকা খরচ করে তবে এই অচলাবস্থা কাটতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
পরিকাঠামো খাতে খরচ করলে বাজার থেকে টাকা উঠে আসতে যে সময় লাগে, সেই সময় মূল‍্যবৃদ্ধি দ্রুত বাড়তে পারে। একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞই নির্ধারণ করতে পারে কিভাবে খরচ করলে মূল‍্যবৃদ্ধির রাশ টেনে রাখা সম্ভব।সেই যোগ‍্য বিশেষজ্ঞই  যদি না থাকে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
স্বাধীনতার পরের উত্তরণ কিন্তু খুব সহজ ছিল না।কিন্তু আমরা একটা সার্বজনীন ,ধর্মনিরপেক্ষ, সহিষ্ণু দেশ তৈরী করতে পেরেছিলাম।অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গ্রাফও দ্রুত উঠছিল।এই পথ থেকে দিকভ্রষ্ট হলে ক্ষতি সবার।একথা যতো দ্রুত বুঝে ওঠা যাবে ,ততই মঙ্গল।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।