বিশ শতকে বাঙালি মনীষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত( জন্ম– ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮০ ,মৃত্যু –২৫ শে ডিসেম্বর ১৯৬১) কে আমরা সাধারণত স্বামী বিবেকানন্দের সহোদর হিসেবেই বিচার করি ।সেই ভাবনা থেকেই তাঁর সম্বন্ধে নানা রকম মূল্যায়ন করে থাকি। বিবেকানন্দের সহোদর ,অতএব তিনি প্রবল আধ্যাত্মবাদী– এইরকম একটি নাক সিঁটকানো ভাবনা থেকে আত্মবিস্মৃত বাঙালি পরবর্তীকালে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিশ শতকের বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষার সে অর্থে কোনো মূল্যায়ন করেনি।
ভূপেন্দ্রনাথ একদিকে ছিলেন ‘যুগান্তর ‘ দলের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। সশস্ত্র বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করবার কর্মকান্ডের অন্যতম প্রধান কান্ডারী। এই কাজে তিনি তাঁর সহোদর স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে কতখানি সাহায্য পেয়েছিলেন, তা নিয়েও কিন্তু পরবর্তীকালে সেভাবে কোনো গবেষণায় হয়নি।
পরবর্তীতে ভগিনী নিবেদিতার সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বিপ্লবী জীবনের প্রথম পর্বেই। সেই সম্পর্কের নিরিখেই একাংশের বাঙালি তাঁকে বিচার করে থাকে ম্যাৎসিনি পন্থী হিসেবে। আবার অনেকে তাঁকে মার্কসবাদী বললেও, মার্কসবাদী বলে যারা নিজেদের দাবি করেন ,তাঁদের ভিতর একটি অংশ ভূপেন দত্তকে মুক্তকণ্ঠে মার্কসবাদী বলতে এখনো অনেক দ্বিধা-সংকোচ মুক্ত হতে পারেন না।
নৃতত্ব বিজ্ঞানে ভূপেন দত্তের যে পাণ্ডিত্য ,তা সমসাময়িককালে কজন ভারতীয় ছিল ,তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করা যায় ।অপরপক্ষে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভেতরে থেকেও সমাজসেবার একদম ভূমি স্তরের সঙ্গে ভূপেন দত্ত ছিল নিবিড় সম্পর্ক ।
প্রথম যৌবনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যে বছর তার সহোদর স্বামী বিবেকানন্দের জীবনাবসান হয়, সেই ১৯০২ সালে ভূপেন্দ্রনাথ ব্যারিস্টার পি মিত্রের বিপ্লবী সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন ।সেখানেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বিপ্লবী যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের ।
এই পর্যায়ে ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে ভূপেন দত্তর একটি নিবিড় রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সহোদর ভুপেনের এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিবেকানন্দ তাঁর জীবনকালে কিছু জানতেন না ,নানা পারস্পরিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তেমনটা কিন্তু মনে হয় না ।
এমনকি নিবেদিতার বিভিন্ন ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকান্ড এবং সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজের ভাই ভূপেনের সংযোগের বিষয়টিও সম্ভবত বিবেকানন্দের অজানা ছিল না। বিবেকানন্দের মৃত্যুর কিছুকাল পরে ভূপেন দত্ত ইতালির বিপ্লবী ম্যাৎসিনি এবং গ্যারিবল্ডির আদর্শে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন।
এই সময়কালে অরবিন্দ ঘোষের সহযোগিতায় যুগান্তর দলের মুখপত্র ‘ যুগান্তর’ সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন।১৯০৬ সালে যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদনের পাশাপাশি ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি ইশতেহার তিনি প্রকাশ করতেন ।সেই ইস্তেহার টিকে ব্রিটিশ সরকার বেআইনি বলে ঘোষণা করায় ১৯০৬ সালে তাঁর প্রথম এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় ।
জেল থেকে বেরিয়ে ছদ্মবেশে তিনি আমেরিকা চলে যান ।১৯১২ সালে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন ভূপেন্দ্রনাথ। তারপর দু বছর পড়াশুনা করেন ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমএ ডিগ্রি পান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে একটা বড় অংশই আমেরিকা থেকে বার্লিনে চলে আসেন ।তাঁদের অনুসরণ করে ভূপেন্দ্রনাথ কিন্তু এইসময়ে বার্লিনে চলে এসেছিলেন ।বার্লিনে চলে এসে ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে একযোগে বার্লিন থেকে বৃটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম কে ঐক্যবদ্ধ করবার কাজে ভূপেন্দ্রনাথ আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
১৯১৬ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বিপ্লবীদের সংগঠন বার্লিন কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ। এই সময় কালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সমাজতত্ত্ব এবং নৃবিজ্ঞান নিয়ে হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে ১৯৩০ সালে ভূপেন্দ্রনাথ ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
জার্মান এশিয়াটিক সোসাইটি এবং জার্মান অ্যানথ্রোপলজিকাল সোসাইটির তিনি বিশিষ্ট সভ্য ছিলেন। তৃতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে যোগ দিতে ১৯২১ সালে ভূপেন্দ্রনাথ মস্কো যান। এই সম্মেলনে বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এবং মানবেন্দ্রনাথ রায় উপস্থিত ছিলেন ।
এই সময়কালে লেনিনের সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় ।লেনিন ভূপেন্দ্রনাথ সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন ।ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিবেশ ,পরিস্থিতি বিষয়ে একটি সন্দর্ভ তৈরি করে ভূপেন্দ্রনাথ সেটি লেনিনকে দিয়েছিলেন।
মস্কো থেকেই ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে শ্রমিক, কৃষক আন্দোলনের একটি বৃহত্তর কর্মসূচি নিয়ে ১৯২৩ সালে তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রেরণ করেছিলেন। ১৯২৭-২৮ সাল নাগাদ তিনি দেশে ফিরে এসে জাতীয় কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হন। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য হয়েছেন ১৯২৯ সালে।
সেই সময়ের রাজনৈতিক ধারা প্রবাহ অনুযায়ী কংগ্রেসের সদস্য থেকেও ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের ভেতরে শ্রমিকের অধিকার আদায় করে নেওয়ার দিকে ছিল ভূপেন্দ্রনাথের সমস্ত কর্মকাণ্ড গতিপথ ব্যাপ্ত।কংগ্রেসের সদস্য থেকেও ব্রিটিশ ভারতের শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকার আদায়ের দিকে লক্ষ্য রেখে জাতীয় কংগ্রেসের ১৯৩৬ সালের করাচি অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গ্রহণে জহরলাল নেহেরুর উপরে বিশেষ রকমের প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ।
১৯৩৬ সাল নাগাদ ই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের একাত্মতা গড়ে উঠতে শুরু করে ।নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশনে পরপর দুবার তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গণসংস্কৃতির পক্ষে সম্মেলন সংগঠিত করতে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বিনয় কুমার সরকার ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সম্বন্ধে যথার্থই মন্তব্য করেছেন;
সকলেই জানে যে ভূপেন দত্ত সেকালের রামকৃষ্ণপন্থী আর একালে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের পথ ও মাড়ান না।
লোকে জানে তাঁকে স্বদেশী যুগের অন্যতম যুগান্তর সাধক ও বিপ্লবী প্রবর্তক বলে ।ভূপেন দত্ত একদিকে কট্টর মাৎসিনিপন্থী ,অপরদিকে কট্টর মার্কসপন্থী ।অধিকন্তু তিনি আবার নৃতত্ত্ব শাস্ত্রী এবং সমাজসেবক ও বটে।
বিবেকানন্দের সহোদর হওয়ার দরুন উগ্র মার্কসবাদীরা ভূপেন দত্তকে মার্কসবাদী বলতে রাজি নন
কিন্তু তাঁরা একথা একবারের জন্য বলেন না যে, বিবেকানন্দের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে আর কেউ নিজেকে প্রকাশ্যে ‘সোশ্যালিস্ট ‘ বলে ঘোষণা করেননি।
এমনটা সেযুগে কোনো ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা করেননি। কোনো সামাজিক নেতা করেননি। কোনো সংস্কৃতিক নেতা করেননি ।বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ করেননি ।বিবেকানন্দ একজন আধ্যাত্মবাদী সন্ন্যাসী হয়েও যেভাবে মুক্তকণ্ঠে সমাজতন্ত্রের সমর্থনে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী শক্তির হাতেই অস্ত্র তুলে দেওয়ার উপক্রম করা হয়।
সোস্যালিজম কে বিবেকানন্দ বলতেন শুদ্র রাজত্ব। মার্কস এঙ্গেলসের রচনার সঙ্গে বিবেকানন্দের কোনো পরিচয় ছিল -একথা প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারা না গেলেও ‘বর্তমান ভারত’ নামক বইটিতে বিবেকানন্দ যেভাবে ইতিহাসের ধারা আলোচনা করেছেন, সেই ধারাকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির থেকে পৃথক করে দেখা কতখানি যুক্তিসঙ্গত ,তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ভূপেন্দ্রনাথ সেই সমাজতন্ত্র কেই তাঁর প্রধান চিন্তা চেতনার বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত করেছিলেন ।আজ যখন রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নানাভাবে বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ,হিন্দুত্বকে হিন্দুইজমের নামে চাপিয়ে দিতে চায়– তখন ভূপেন্দ্রনাথ , তাঁর মতো মানুষ, তাঁর জীবন চর্চা ,তাঁর গোটা জীবনের রাজনৈতিক প্রবাহ ,বিভিন্ন লেখালেখির চর্চা ,সামগ্রিকভাবে আমাদের কাছে একটা বড় রকমের হাতিয়ার। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ,মৌলবাদের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে ,লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ,অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ,মানবাধিকারের পক্ষে ভূপেন দত্তর জীবন ও লেখালেখি আজ আমাদের বিশেষভাবে চর্চা করার প্রয়োজন।