কলমের খোঁচা

ঊষা দি এভাবে চলে যেতে হয়? — চয়ন ভট্টাচার্য


চিন্তন নিউজ:২৩শে এপ্রিল:- এতই অকস্মাৎ তাঁর এই চলে যাওয়া, লক ডাউনের এই অবরুদ্ধ সময়ে পঁচাত্তর বছর বয়সী ভারতের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ও নাট‍্যপরিচালক ঊষা গাঙ্গুলি এমন নিতান্তই নিঃসঙ্গ এক সাধারণ প্রবীণার মত নিজের বাসভবনে প্রয়াত হলেন যা কোনভাবেই মানা যায় না। নাট‍্যমঞ্চ থেকে এমন একজন শিল্পী আজ বিদায় নিলেন যিনি থিয়েটারের জন‍্য নিজেকে তিলে তিলে তৈরি করেছিলেন। জন্মসূত্রে বাংলাভাষী নন ঊষাদি মানে ভারতের কিংবদন্তি নাট্য ব‍্যক্তিত্ব ঊষা গাঙ্গুলি অথচ বাংলা নাট‍্যজগতের একান্ত আপনজন এবং অভিভাবকও ছিলেন এবং দিল্লী বা মুম্বাই নয় গোটা নাট্য জীবনই কাটিয়ে গেলেন কলকাতায়। কলকাতার মঞ্চে চুয়াল্লিশ বছর টানা হিন্দি নাটক করেও বাঙালির আপনজন হওয়া বড় সহজ কথা নয়। যে তিনজন পেরেছিলেন শ‍্যামানন্দ জালান, প্রতিভা আগরওয়াল এবং ঊষা গাঙ্গুলি -প্রথম দুজন আগেই প্রয়াত আজ শেষ জন কেও বিদায় জানাতে হল।

হিন্দি সাহিত‍্যের অধ‍্যাপিকা ছিলেন। ছাত্রী অবস্থায় কলকাতায় এসে শ্রী শিক্ষায়তনে পড়া এবং হিন্দি সাহিত্যে এম এ পাশ করে ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজে অধ‍্যাপক হিসাবে ২০০৮ সাল অবধি পুরো কার্যকাল শেষ করতে করতে পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। জীবনসঙ্গী কমল গাঙ্গুলি র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৭১ সালে আশ্রয় দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন মুক্তি যোদ্ধা কে। তার ঠিক আগের বছর ১৯৭০ সালে সঙ্গীত কলামন্দিরের প্রযোজনা শূদ্রকের সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিক অবলম্বনে রচিত হিন্দি নাটক মিট্টি কা গাড়ি নাটকে “বসন্তসেনা” চরিত্রে অভিনয় সম্ভবত ঊষা গাঙ্গুলি র নাট‍্যজীবনের দিকনির্ণয় করে দিয়েছিল। পর পর অসংখ্য নারী চরিত্র কেন্দ্রিক নাটকে ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থানকে পরবর্তীকালে মঞ্চায়নের মাধ‍্যমে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করে যিনি স্বতন্ত্র আসনে অধিষ্ঠান করবেন, বসন্তসেনার মত একটি ধ্রুপদী নির্ণায়ক চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়ে নিয়ে ঊষা গাঙ্গুলি সেই পথেই নিঃশব্দে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
১৯৭৬ সালে নিজের নাটকের দল রঙ্গকর্মী তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ঊষা গাঙ্গুলি পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন নি। বরং নিজেকে এবং দলের সহকর্মীদের তৈরি করার জন‍্য তিনি আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন এম.কে.আনভাসে,তৃপ্তি মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত,বিভাস চক্রবর্তীর মত অভিজ্ঞ নাট্য পরিচালকদের। ইবসেনের নাটক ডলস হাউস অবলম্বনে তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় “গুড়িয়া ঘর” ই রঙ্গকর্মীর প্রথম সাড়া জাগানো প্রযোজনা। অভিনেত্রী ঊষা গাঙ্গুলিকেও কলকাতার থিয়েটারের দর্শক চিনলেন এই নাটক থেকেই। তখনই পরিচালক হিসাবে নিজেকে তৈরি করার জন‍্য ঊষা গাঙ্গুলি তৃপ্তি মিত্র ও মৃণাল সেনের কাছে ছাত্রীর অধ‍্যবসায় নিয়ে পাঠ নিচ্ছেন।

১৯৮৪ সালে একঝাঁক নতুন শিল্পী নিয়ে মন্নু ভাণ্ডারীর লেখা ‘মহাভোজ” নাটকে পরিচালক হিসাবে ঊষা গাঙ্গুলি র প্রথম কাজ। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয় নি। ছত্রিশ বছরের পরিচালক জীবনে যে নাটকের জন‍্য তাঁর সর্বাধিক খ‍্যাতি তা হল মহাশ্বেতা দেবীর লেখা কাহিনী অবলম্বনে রুদালী। শনিচরী চরিত্রে ঊষা গাঙ্গুলি র অবিস্মরণীয় অভিনয়ের কারণেই রঙ্গকর্মীর ইতিহাসে রুদালীর সর্বাধিক শো হয়েছে এ বিষয়ে কারুর দ্বিমত থাকতে পারে না। ২০০৪ সালে এই নাটকটি নিয়ে রঙ্গকর্মী জার্মানির স্টুটগার্টে আন্তর্জাতিক নাট‍্যোৎসবেও অংশ গ্রহণ করেছিল।

ঊষা গাঙ্গুলির নির্দেশনায় রঙ্গকর্মীর কোর্ট মার্শাল, হোলি,হিম্মতমাঈ, অন্তরযাত্রা, কাশীনামা র মত প্রযোজনা শুধু কলকাতা নয় সারা ভারতেই সমাদৃত হয়েছিল। সম্ভবত তিনিই কলকাতার একমাত্র পরিচালক যিনি কিংবদন্তি হাবিব তনবিরের নয়া থিয়েটারের সঙ্গে রঙ্গকর্মীর যৌথ প্রযোজনা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাটকের হিন্দি রূপান্তর বিসর্জনে অংশগ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট নৃত্য নাট্য চণ্ডালিকার হিন্দি নাট‍্য রূপান্তর তাঁর নির্দেশনায় রঙ্গকর্মী মঞ্চস্থ করেছে। সাদাত হোসেন মান্টো কেও কলকাতার মঞ্চে এনেছেন তিনিই।
ঊষাদির প্রযোজনার দুটি বৈশিষ্ট্য নাট্যকর্মীদের আকৃষ্ট করত। প্রথমত থিয়েটারে সামাজিক বার্তা পৌঁছে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতেন না,মঞ্চায়নের মান উন্নত করার জন‍্য সমকালীন শ্রেষ্ঠ কলাকুশলীদের যুক্ত করে নিতেন যাতে দলের সহকর্মীরা শেখার সুযোগ পায়। রঙ্গকর্মীর প্রযোজনায় খালেদ চৌধুরী,সুরেশ দত্ত থেকে তাপস সেন,জয় সেন কে কাজ করেন নি?এবং দ্বিতীয়ত নিম্নবর্গীয় জনগণ যাঁরা আসল ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁদের জীবন্ত ভাবে মঞ্চে তুলে আনতে শিল্পীদের ও মঞ্চ কে একান্তই নিজস্ব ভঙ্গিতে ব‍্যবহার করে দর্শকদের হৃদয়কে ধাক্কা দেওয়া। যে কারণে রুদালী, হিম্মতমাঈ,মহাভোজের মত প্রযোজনা ইতিহাস তৈরি করতে পেরেছে।

উচ্চস্বরে শ্লোগান না তুলেও কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের মঞ্চে অনেক শিল্পী নিয়ে মঞ্চকে সম্পূর্ণ ব‍্যবহার করে নাটকে শ্রেণী সংগ্রামের বার্তা দেওয়া এক যথার্থ বিরল প্রতিভাবান পরিচালকের যাত্রা আজ শেষ হল।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।