কলমের খোঁচা

কলাগরু বিষ্ণু প্রসাদ রাভার মৃত্যু তিথিতে বিপ্লবী কবির প্রতি চিন্তনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


সীমা বিশ্বাস:- আসাম,২০জুন: চিন্তন নিউজ:– অসমের সমাজ সাংস্কৃতিক জীবনে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। জীবনে যে কয়েকজন মহান ব্যক্তি তাঁদের বিরল ব্যক্তিত্বের অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন তাদের ভিতর শংকরদেব লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা ,ডক্টর ভুপেন হাজারিকা ইত্যাদি এসকল বরেণ্য ব্যক্তির মতই কলাগুরু বিষ্ণু প্রসাদ রাভা অন্যতম বরেণ্য ব্যক্তি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা ছিলেন একাধারে চিত্রশিল্পী সঙ্গীতজ্ঞ নিত্য বিশারদ অভিনেতা সুবক্তা তথা সুনিপুণ খেলোয়াড় । প্রকৃতার্থে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা ছিলেন মূলত একজন বিপ্লবী শিল্পী।শিল্প সাধনার সঙ্গে তিনি সমানভাবে সাহিত্য সাধনা করেছিলেন । অসমীয়া সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের গীত কবিতা নাটক গল্প-উপন্যাস সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন প্রবন্ধকে ধরে প্রায় সকল ক্ষেত্রে অসমীয়া সাহিত্যের সমৃদ্ধশালী করে তোলার প্রয়াস করেছিলেন। অসমীয়া ছাড়াও বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা আরো ১৭টা ভাষা তিনি জানতেন। বিপুল প্রতিভার অধিকারী বিষ্ণুর প্রসাদ রাভার জন্ম হয়েছিল ১৯০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায়। তাঁর পিতার নাম ছিল গোপালচন্দ্র রাভা । তিনি একজন সেনা বিষয়া ছিলেন।জন্মস্থান ঢাকাতেই প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে তেজপুরে তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে ১৯২৬ সালে তিনি প্রথম বিভাগে মেট্রিকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলিকাতার সেন্টপল কলেজে আইএস সি শ্রেণীতে নাম ভর্তি করেন। এই অধ্যয়নের সময়ে বিষ্ণু রাভা
কলা চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯২৮সনে আইএস সি উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা রিপন কলেজে নাম ভর্তি করে কলকাতা বিএসসি কলেজে বি এস সিতে নাম ভর্তি করে।১৯৩১ সনে কলেজ জীবন অসমাপ্ত করে রাভা অসমের তেজপুরে চলে আসেন। ‌‌

বিষ্ণু প্রসাদ ছিলেন বিপ্লবী। উনি ছিলেন জনতার শিল্পী। ১৯৪৫সন থেকে গণসংগঠনের কাজে নেমে পড়েছিলেন এবং অসমকে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি সাম্যবাদী চিন্তাধারার প্রতি আকর্ষিত হন। রাভা দেবের বিপ্লব ছিল গরিব শ্রমিকদের জন্য কৃষক মুক্তির জন্য ধনী শোষক শ্রেণী এবং সরকারের বিরুদ্ধে। যার জন্য সরকারের রোষে পড়ে তিনি ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেরিয়েছেন জঙ্গলে জঙ্গলে বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে এমনকি তাকে কারাবাস পর্যন্ত থাকতে হয়েছিল । তাঁর বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা উপেন শর্মার সঙ্গে১৯৪৫ সালের শেষের দিকে পার্টি সান্নিধ্যে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব স্থাপন হয়।

অসমের বিশাল কৃষক সমাজের মধ্যে এবং শ্রমিক-কৃষক সকলের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার জন্য রাভা তৎপর হয়ে ওঠেন হাতে কলম তুলে নেন এবং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে তিনি গীত আলেখ্য নাটক গল্প প্রবন্ধ রচনা করেন। উদ্দেশ্য তার একটাই ছিল জনগণকে সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। ১৯৫২ সনে রাভা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী রূপে বরপেটা সমষ্টির থেকে সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ১৯৫৭সনে নির্বাচনে রঙ্গিয়া সমষ্টির থেকে ট্রাইবেল প্রার্থী হিসাবে কম্যুনিস্ট পার্টিতে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে ছিল যদিও পরাজয় বরণ করে।

১৯৬২ সনে চীন ভারত আক্রমণ করার সময় ভারত সরকার কমিউনিস্ট নেতাদের আটক করে জেলহাজতে রাখে এবং একদিন রাত্রে বিষ্ণু রাভা কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে নিয়ে যায়। মাতৃহীন শিশু দুটোকে বিছানায় রেখে তাঁর জেলে যেতে হয়েছিল ।উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলার বহরমপুর জেলে রাভাকে বন্দী জীবন কাটাতে হয়। জেলের ভিতর রাভা গীত ,কবিতা লেখেন।১৯৬৩ সনে রাভা মুক্তিলাভ করে।১৯৬৮ সনে রাভা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।

১৯৬৯সনে ২০জুন তারিখে এই মহান ব্যক্তি বিষ্ণুপ প্রসাদ রাভার জীবন দীপ নির্বাপিত হয়। অসমের জাতীয় জীবনের এক অন্যতম মহান শিল্পী বিষ্ণু প্রসাদ রাভা। নানা দিক থেকে
অসমীয়া সু্রের গান,নাটক নৃত্য, নাটিকা ইত্যাদির মাধ্যমে অসমীয়া সাংস্কৃতিক জগত ভিন্ন রূপ দিয়ে গেছেন।এইজন বহুমুখী প্রতিভাবান শিল্পী র গীত রচনা পদ্ধতি এবং সুর সংযোজন জ্যোতিপ্রসাদের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আধুনিক অসমীয়া সংগীতের বিপ্লব এনেছিলেন। বিষ্ণু প্রসাদ রাভার বর্ণিল অবদানে নিজেই এক অনুষ্ঠানে পরিণত হওয়া এক অনুপ্রেরণা মূলক সত্তা।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।