কলমের খোঁচা

সোমেন চন্দ’-র ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য


শ্রীরূপ গোপাল গোস্বামী ,নিজস্ব প্রতিবেদন: চিন্তন নিউজ:২৪শে মে:– ১৯২০ সালের ২৪মে অবিভক্ত বাংলার নরসিংদী জেলায় এক অত্যন্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন সোমেন চন্দ। ফলে অভাব এবং দারিদ্র্যতার মধ্যেই বড় হন। সোমেন চন্দের জন্মকালের প্রেক্ষাপট ছিল খুব ঘটনাবহুল। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ায় রুশ বিপ্লব ঘটে গেছে। ফলস্বরূপ পৃথিবীর নানা প্রান্তে মুক্তির আন্দোলন দানা বাধছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ফ্যাসিস্ট চরিত্র নগ্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। এদিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসহযোগ- সত্যাগ্রহ আন্দোলন এক নতুন মাত্রা যুক্ত করলেও পাশাপাশি অন্যধারার আন্দোলনও চলতে থাকে। বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে কমিউনিষ্টদের লড়াই-সংগ্রামের সুবিশাল ইতিহাস রয়েছে। তারা জেল খেটেছে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়েছে। তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল জাতীয়তাবাদীদের হাতে।

১৯৩৬ সালে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। ছাত্রাবস্থাতেই মার্কসীয় রাজনীতি এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। মার্কসীয় দর্শন অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে সোমেন চন্দ সমাজের দ্বন্দ্বগুলো পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। সেকারনেই তিনি ধর্ম-জাতীয়তাবাদ অতিক্রম করে নিজেকে একজন ফ্যাসিবাদবিরোধী সমাজবিপ্লবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

সোমেন চন্দ খুব অল্প বয়সেই গল্প লিখতে শুরু করেন। জ্ঞানের অনুশীলনকে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ন মনে করতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পুঁজিবাদ তার অগ্রগতির জন্যই ফ্যাসিবাদকে হাজির করে। রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে প্রান্তিক মানুষকে শোষণ করতে। তিনি উপলব্ধি করেন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, নিজেদের অন্যায় শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্ম- জাতীয়তাবাদ- সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে।

সোমেন চন্দের গল্পগুলোতে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। চল্লিশের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি যে গল্পটি লেখেন তা হলো “দাঙ্গা”। দাঙ্গা গল্পে শহরের মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উগ্রতা, দারিদ্র্যের করুণ চেহারা সুনিপুণভাবে প্রকাশ করেছেন।

সোমেন চন্দ লিখিত ইঁদুর গল্পটি বিখ্যাত। সে ইঁদুর পুঁজিবাদের তৎপরতার। পুঁজিবাদের উৎপাতের। একটি দরিদ্র পরিবারকে গলির ভেতর চেপে রেখেছে যে শত্রু সেটি দাঙ্গা নয়, দারিদ্র্য।

সোমেন চন্দ পাঠাগার আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। ঢাকার নারিন্দাতে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন। সোমেন চন্দ ছিলেন একাধারে একজন লেখক আবার একজন বিপ্লবী। লড়াই-সংগ্রামে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সবসময় মিছিলের অগ্রভাগে থাকতেন। সোমেন চন্দ কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন পাশাপাশি ইষ্ট বেঙ্গল রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। রেল শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতেন। রাতভর লিখতেন। তিনি প্রগতি লেখক সংঘেরও অন্যতম কর্মী ছিলেন।

১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজ়ীবি, লেখক প্রভৃতি শহরে এক ফ্যাসীবাদ বিরোধী সম্মেলন আহবান করেন। স্থানীয় জেলা পার্টির অনুরোধে কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি ও জ্যোতি বসু সেখানে বক্তা হিসেবে যান। সম্মেলন উপলক্ষে শহরে খুবই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক মহল প্রায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম যারা সম্মেলনের পক্ষে, দ্বিতীয় যারা সরাসরি বিপক্ষে, তৃতীয় যারা মোটামোটিভাবে নিরপেক্ষতার আবরণ নিয়েছিলেন।শেষোক্তদের মধ্যে প্রধানত কংগ্রেস মতবাদের অনুসারীরা ও দ্বিতীয় দলে ছিলেন জাতীয় বিপ্লবী, বিশেষত শ্রীসংঘ ও বিভির লোকেরা। সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ মিছিল করে যাওয়ার সময় আততায়ীদের হাতে নিহত হন। তিনিই বাংলার ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। গুরুত্বপূর্ণ হল এই যে হত্যাকান্ডের পরও যথারীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।



মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।