কলমের খোঁচা

ডঃ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি—সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:২৪শে অক্টোবর:—-শ্রদ্ধাস্পদেষু,
ডঃ অমর্ত্য সেনের পর আরো একজন বাঙালি হিসাবে আপনার নোবেল জয়ে আমরা গর্বিত,আপনার পূর্ণতাপ্রাপ্ত অধ্যাবসায় ও শ্রমসাধ্য গবেষণার বিষয় বস্তু দরিদ্র মানুষের জীবন যন্ত্রণার অনুভবে সংশ্লেষিত যা আমাদের গগনচুম্বি উচ্ছাস ও তৃপ্তির সঙ্গত কারন।

আপনার নোবেল প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় অর্বাচিন বিজেপি নেতাদের কুশিক্ষাশ্রয়ী, রুচিহীন অসভ্যতামিকে সুসংস্কৃত এই বাংলার মর্যাদা রক্ষার দায় বিবেচনায় তীব্র ঘৃণা আর ধিক্কারে প্রত্যাখ্যান করেছি আমরা। এ আমাদের শ্লাঘা। আমাদের জাতীয় জীবনে লুঠ সর্বস্ব প্রবঞ্চক অর্থব্যবস্থার বিপ্রতীপে আপনার সাবলীল উপস্থিতি ও বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর এদেশের শ্রমজীবি আন্দোলনের উজ্জীবিত উপাদান হিসাবেই সযত্ন সঞ্চয়ে রেখেছি আমরা। কিন্তু গুস্তাকি মাফ করবেন স্যার আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে একেবারেই একমত হতে পারলাম না,—


আপনি বলেছেন –“বামপন্থী সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কী করেছিল, আমি তা একেবারে চোখের সামনে দেখেছি। মাস্টারমশাইদের যেখানে খুশি বদলি করে দেওয়া,কলেজের জন্যে টাকা পয়সা না দেওয়া, আজেবাজে লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে বসিয়ে দেওয়া…আমার বাবাতো তা নিয়ে সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।” (সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩ অক্টোবর ২০১৯ )। অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞ হলেও এটুকু বোধকরি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি আপনার মতো খ্যাতিমান মানুষের অমূল্য গবেষণার কাজে প্রকৃত ও সঠিক তথ্য অত্যন্ত মূল্যবান আকর হিসাবেই বিবেচিত হয়। আপনার প্রতিটি মূল্যবান মুহূর্ত থেকে মাত্র কয়েকটি বাঁচিয়ে একটু দৃষ্টি দিলে আশাকরি দেখবেন প্রকৃত তথ্যের (এবং সত্যের) সঙ্গে আপনার বক্তব্যের আড়াআড়ি অমিল।

বামপন্থী সরকারের সময় এই রাজ্যে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা-পরিকাঠামোর ব্যাপক ভিত্তিক উন্নতির পরিকল্পিত পদক্ষেপ,মাননীয় শিক্ষক সমাজের আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত আন্তরিক উদ্যোগ সারা দেশে আজো অম্লান। কিন্তু আপনার মতো প্রতিভাধর অনুসন্ধিৎসু বিশ্লেষকের কাছে এ কথা তুলে ধরা আমার উদ্দেশ্য নয়, এবং এ ধৃষ্টতাও আমার নেই, যে বিনয়ের সঙ্গে আপনার কাছে এই অনুযোগ করবো, প্রসঙ্গক্রমেও আজকের পশ্চিমবঙ্গের পরিমন্ডলে আরো পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেরও করুণ বেহাল অবস্থা নিয়ে, মাননীয় শিক্ষককূলের চূড়ান্ত অমর্যাদা সম্পর্কে আপনি একটি শব্দও ব্যয় করলেননা কেন? আপনার দৃষ্টিতে(মানে ‘চোখের সামনে’)যা ধরা পড়েছে তা আপনি অকোপটে সোজাসাপ্টা করে বলেছেন,কোনো ভনিতা করেননি। এ নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ থাকলেও আপত্তির কিছু থাকতে পারেনা। আর বামপন্থী সরকারের সময়েও এমনকি শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ তো আছেই, ছিলই। বিশেষকরে শিক্ষার ব্যাপকতম বিস্তৃতির একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে যথাযথ গুণমান স্থাপনের প্রশ্নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও পদ্ধতি নির্ণয়ের প্রেক্ষিতে কিছু সমালোচনার সুযোগ তো আছেই। সকলের মনে থাকবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ও সমাজবিজ্ঞানী ডঃ অশোক মিত্র তার বলিষ্ঠ কলমে একাধিকবার তা তুলেও ধরেছেন যুক্তি ও তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কঠোর হলেও মান্যতা পাওয়ার যোগ্য। সুতরাং এ নিয়ে কিছু বলার থাকতে পারেনা।

আমার (তীব্র)আপত্তি ও (চরম) বিরুদ্ধতা আপনার বক্তব্যের এই অংশটুকু নিয়ে, “…আজেবাজে লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে বসিয়ে দেওয়া…”। উপাচার্য নিয়োগে বামপন্থী সরকারের পদ্ধতি,সংশ্লিষ্ট উপাচার্যদের যোগ্যতা,দক্ষতা এসব নিয়ে আপনি আপনার মত করে একবার কেন হাজারবার সমালোচনা করতে পারেন, এনিয়ে কেউ সহমত পোষণ করতে পারেন কেউবা দ্বিমত। কিন্তু তাই বলে ‘আজেবাজে লোক’!! মুহূর্তের অসাবধানতা বশতও আপনি এই শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করতে পারেন ? ডঃ রমেন পোদ্দার, ডঃ পবিত্র সরকার, ডঃ শুভঙ্কর চক্রবর্তী,ডঃ সুরভি বন্দোপাধ্যায়, ডঃ আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়, ডঃ সুকমল সেন প্রমূখ এঁরা আপনার বিচারে অযোগ্য,অদক্ষ হতেই পারেন, তাবলে ‘ আজেবাজে লোক ’? নিজনিজ ক্ষেত্রে এঁদের স্বীকৃত অবদান সম্পর্কে কী তাহলে আপনি অবহিত নন ? নাকি দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারনে বাংলাভাষার সঙ্গে আপনার সংযোগহীনতা এর কারন? কিন্তু তাওতো মেনে নেওয়া কঠিন, এ যুক্তি খন্ডন করবার জন্যেও তো পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং অমর্ত্য সেন, অতএব আমার প্রতিবাদ একটু ঝুঁকি নিয়েই নথিভূক্ত করে রাখলাম। কারন আপনি যেমন আমাদের গর্ব তেমনি আপনার কথিত ‘আজেবাজে লোক’ এঁরাও আমাদের অহংকার।

পুনশ্চঃ হঠাৎ মনে এলো তাই একটু পুরোনো একটা ঘটনার উল্লেখ করছি, তাও বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির মুখপত্র গণশক্তিতে একটি নিবন্ধে প্রখ্যাত অর্থনীতিবীদ, পরবর্তীকালে বহূ বিখ্যাত অর্থনীতিবীদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ডঃ ভবতোষ দত্তর একটি বক্তব্যের (কি বক্তব্য তা আজ আর স্মরণে নেই) সমালোচনা করা হয়েছিল যা আসলে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে অযাচিত আক্রমণ ও অসন্মানের সামিল ছিল। পরেরদিনই ওই কাগজেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে ও ডঃ দত্তর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠি লিখেছিলেন সিপিআই(এম) নেতা,অর্থনীতিবীদ ও ডঃ ভবতোষ দত্তর সুযোগ্য ছাত্র ডঃ বিপ্লব দাশগুপ্ত শুধু তাই নয় তার বাড়ীতে গিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে এসেছিলেন, বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

শ্রদ্ধা নিবেদনান্তে
আপনার প্রতিভার কাছে নতমস্তক —সঞ্জীব বর্মণ।

                   


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।