কলমের খোঁচা

মাঝামাঝি কোনো পথ নেই, দেখুন কি করবেন — — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:৩০১শে মে:– করোনা কারনে বা প্রকারান্তরে তার অসীম করুণায় ভারতীয় গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মর্যাদা রক্ষার সংকল্পে একনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে সতত বিরামহীন এই খোলা বাজারে বহুল প্রসারিত ও প্রচারিত ‘জাগ্রত বিবেক’ সংবাদপত্র এবং সুমনানন্দে মোহিত সংবাদ চ্যানেলের সৌজন্যে আমাদের সব উদ্বেগ নিরসন করে জানতে পারছি আর ভারমুক্ত হচ্ছি এই লকডাউনের দুঃসহ সময়ে তাঁরা, মানে আমাদের টলিউড, বলিউড আরো নানান জগতের হরেক কিসিমের সেলিব্রেটি নক্ষত্রমন্ডলী বা যাদের অসীম দয়ার দানে আমরা দেশবাসী বেঁচেবর্তে আছি সেই আমাদের শিল্পমালিক, ধনকুবের কর্পোরেট কর্তাগণ সপরিবারে কে কেমন আছেন। তারা কিভাবে এই অলস সময় ধারা বেয়ে অতি কষ্টে হৃদয়,মনকে শূণ্যপানে থিতু করে তাদের অতি ব্যস্ততম বর্ণময় জীবন অতিবাহিত করছেন, কেমন চলছে তাদের সন্তান সন্ততিদের অনলাইনে অঙ্ক ক্লাস, কেমনভাবে “টম এ্যন্ড জেরি” বা “মিস্টার বিন” দেখতে দেখতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে কারুর ছোট্ট সোনামণি বা এই সদ্যসদ্য ইনভেন্ট করা কম্পিউটার গেমে সেঁধিয়ে গিয়ে নাওয়া-খাওয়া সব ভুলেছে কারুর কৈশরকে সবে বিদায় সম্ভাষণ জানানো মেধাবী সন্তান অথবা কোনো ‘কর্পোরেট কর্তা’ অনুগত স্বামীর কাঁচা হাতে হঠাৎ খেয়ালে ডিমের ওমলেট বানাতে গিয়ে ডান হাতের কড়ে আঙুলের ডগায় দূরবিক্ষণ যন্ত্রে দৃশ্যমান ফোসকা দেখে কিরকম চঞ্চল অস্থির হয়ে উঠেছেন বক্সঅফিস কাঁপানো কোনো জনপ্রিয় নায়িকা। মন ও শরীর দুই ঠিক রাখতে এদের কেউ করছেন জিম তো কেউ ব্যস্ত যোগা-য় , কেউ ব্যস্ত ট্রেডমিলে তো কেউ আপন “ছোট্ট” গৃহ কোনের মনোরম সুইমিং পুলে, এ সব জানতে পারছি। জানতে পারছি কোন্ কোন্ দয়ারসাগর শিল্পপতি তার তিল তিল করে গড়ে তোলা কষ্টার্জিত, কঠোর পরিশ্রম লব্ধ সঞ্চয় থেকে একশ,দুশো, পাঁচশ কোটি বা তারও কিছু বেশি নগদ মারণ করোনা হামলায় সবচাইতে বিধ্বস্ত দেশের খরচার খাতায় নাম লেখানো গরিব গুলোর জন্যে কিভাবে অকাতরে হাতখুলে, মনখুলে বিলিয়ে দিচ্ছেন ইত্যাদি প্রভৃতি।

এইসব অবশ্য জ্ঞাতব্য সংবাদ অহরহ তথ্য প্রমাণাদিসহ জানতে পারছি গণতন্ত্রের এই বিশ্বস্ত বাহন ছিল বলেই না।শ! জানতে পারছি আর বিগলিত হচ্ছি- “প্রাণ আছে, প্রাণ আছে এখনো প্রাণ আছে”, অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতায় আচ্ছন্ন হচ্ছি, বাহবা দিচ্ছি আমাদের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বৃহত্তর সংবাদ মাধ্যমকে আর অন্তরের অন্তস্থলের সমস্ত আবেগকে সর্বশক্তি দিয়ে একত্রিভূত করে আউরে চলেছি, “ধন্যি রাজার ধন্য দেশ”। তখন, ঠিক তখনই পাতে দেওয়ার অযোগ্য, কোলে ঝোল টানা এবং একপেশে,আর ওই মুখোশের আড়াল ছেড়ে মুখোমুখি না কি যেন একটা কর্পোরেট কৌলীন্যহীন ‘গণশক্তি’তে কে একজন উটকো, সামান্য সাংবাদিক মর্যাদা পাওয়ারও নেহাতই অযোগ্য রণদীপ, রণদীপ মিত্র মজে যাওয়া মনে ঝামা ঘসে দিয়ে লিখেছে “ঘরের পথে হাঁটতে গিয়ে মৃত বাংলার শ্রমিক”, ওড়িশার এ্যাসফাল্টের রাস্তায় বড় হাইড্রেনের ধারে শুকনো এক টুকরো কঠের মতো পড়ে থাকা “স্পার্টাকাশের উত্তরাধিকারী” বীরভূমের নলহাটীর ইয়ার মহম্মদের লাশ। যাদের পেটে, পিঠে, আর কপালে লটকানই আছে মৃত্যু পরোয়ানা, শুধু বেঁচে থাকতে চাওয়াটাই যাদের দণ্ডনীয় অপরাধ তাদেরই একজন, এই মহাবিশ্বে নিতান্ত রবাহুত ইয়ার মহম্মদ। তার নিজের ঘরে ফেরার, ফিরতে চাওয়ার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় অতএব অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রাষ্ট্রের সময় নেই, সংবিধান রক্ষকদেরও কোনো দায় নেই, প্রয়োজনও নেই। সুতরাং বীরভূমের ইয়ার মহম্মদদের মতো হাজার হাজার ইয়ার মহম্মদদের বাঁচার জন্যে হাঁটতে হবে, হাঁটতে হাঁটতেই বাঁচতে হবে। হাঁটা থামলেই ইয়ার মহম্মদ লাশ, শুধু একটা লাশ। খুব বেশি হলে বাড়তি একটা শব্দ যুক্ত করে কৌলীন্য বাড়িয়ে বলা যেতে পারে পরিযায়ী লাশ।ভোটার তালিকা থেকে রেশন কার্ড থেকে বা আধার কার্ড থেকে আর ব্যস্ত উন্নত সভ্যতার স্মৃতি থেকে নিমেষে মুছে যাওয়া একটা পরিযায়ী লাশ। গতর ছাড়া মূল্যহীন যার থাকাটাই বিরক্তীর সে যদি ফাঁক তালে চলেই গেল তাতে মহা-মহিম রাষ্ট্রের কী এলো গেলো !! হায়, তাকে নিয়ে কিনা আবার সংবাদ! কিন্ত নাছোড় গণশক্তির নাছোড় সেবক রণদীপ তবু লিখেছেন,“ টেলিফোনে ছোট্ট সুহানা বলেছিল,‘দাদা তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো।’ বছর দশেকের নাতনির ডাক আর ফেরাতে পারেননি ইয়ার মহম্মদ। বলেছিলেন,’হ্যাঁ রে বেটি, ফিরে যাবো, এখানে কাজ নেই, খাবার নেই, বড্ড কষ্ট।’ দিন দশেক আগে বীরভূমের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন পেটের তাগিদে ভিনরাজ্যে যাওয়া শ্রমিক। ছেলে কাজল শেখ জানালেন, তারপর আর কথা হয়নি।… শুক্রবার সন্ধ্যায় ইয়ারের ভাই দোস্ত মহম্মদ জানালেন, কখনো ট্রাকে, কখনো ট্রেলার যখন যা পেয়েছেন তাতেই উঠে পড়েছেন। অনেক সময়েই আবার হাঁটতে হয়েছে। কাল সন্ধ্যায় একটা ট্রাকে উঠেছিলেন। মামা আলমগীর কাজলকে বলেছেন, ‘রাতে বৃষ্টি আসায় ট্রাক ড্রাইভার ওঁদের নামিয়ে দেয়। হাইওয়ের ধারে একটা বারান্দায় ওরা পাঁচজন শুয়েছিল। সকালে উঠে দেখে, বাবার ধরে আর জান নেই।” মানে লাশ। হাঁটা শেষ,স্বপ্ন শেষ, ছোট্ট নাতনি সুহানার কাছে এসে তাকে বুকের আরো কাছে টেনে নেওয়ার আকুল ইচ্ছা তাও শেষ, সূতরাং বাঁচা শেষ।

ইয়ার মহম্মদ এখন শুধু একটা লাশ। কি হলো, আপনি কি ভাবছেন! “সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান,/ সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ”, নাকি আপনি কাঁদছেন? গাল বেয়ে প্রবল- বাঁধহীন, বাধাহীন প্রবহমাণ আপনার এক জোড়া চোখের জল কি এখন বারুদ হয়ে অনিবার্য ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ? চঞ্চল,ধৈর্য্যচ্যুত, অসহিষ্ণু—আপনার ক্ষতবিক্ষত অন্তরের অন্দরে কী সব অন্যায়, অপরাধ গলিত গরম লাভায় নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যাভিমুখি ঘৃণার ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠার নিশ্চিত পূর্বাভাস ? আজকের পেইড নিউজের রমরমার যুগে গেরে বসা হলুদ সাংবাদিকতার ঢালাও নির্লজ্জ কারবারের বিপ্রতীপে সত্য,সৎ, স্বচ্ছ ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত সাংবাদিকতার মশালবাহী গণশক্তি, তার সাংবাদিক রণদীপ, রণদীপদের দ্বিধাহীন দায়বদ্ধ বলিষ্ঠতায় কৃতজ্ঞ আপনি, কোনো অভিনন্দনই ওঁর,ওঁদের জন্যে যথেষ্ঠ নয় এই আত্মশ্লাঘায় উদ্বুদ্ধ আপনি, উজ্জিবিত আপনি কী ধূসর ধুলির পথে ভেঙে পড়ে থাকা যুদ্ধরথ উদ্ধার করে, তাকে আবার পুনর্নিমাণ করে বহু, বহুদূর পারি দেওয়ার প্রতিজ্ঞায়, অপ্রতিরোধ্য লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করছেন ? দাঁড়ান, আপনার প্রস্তুতির তালিকা দীর্ঘ করে আরো একটি ঐতিহাসিক উপদেশ আপনার জন্যে অপেক্ষায়। “অন্য রাজ্য থেকে করোনা আক্রান্তরা আসছেন। শ্রমিক এক্সপ্রেস তো করোনা এক্সপ্রেস হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মধ্যপ্রদশের মতো হটস্পট থেকে আসছে। এরজন্যই করোনা বাড়ছে। এখন আর কিছু করার নেই, সব কিছু আমার হাতে নেই, করোনাকে নিয়েই ঘুমোন, করোনাকে পাশবালিশ করে ঘুমোন।” না, ভুল করেও ভুল ভাববেন না যেন যে, এটা তৃতীয় শ্রেণীর কোনো রগরগে চলচিত্রের গোটা পাঁচ, দশ বা পনের অন্ধকারের জীব পরিবেষ্টিত এবং ততোধিক অন্ধাকারের উপাসক কোনো খলনায়ক (অথবা খল নায়িকার)’ র মুখে বসানো কাল্পনিক সংলাপ ! অথবা অশ্লীল, অমানবিক এবং চরম অপমামকর এই বচন কোনো দাগী সমাজ বিরোধীর মুখ নিঃসৃত অমৃত বাণী ! এটা আসলে আমাদের সুখ স্বাচ্ছন্দের সদা সতর্ক প্রহরী আমাদের প্রিয় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর আমাদের জন্যে হিতোপদেশ। অতএব একে মোটেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেন না। অনেক টালবাহানার পর এই রাজ্যের ঘরছাড়া, সর্বস্বান্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো ট্রেনকে করোনা এক্সপ্রেস বলে কটাক্ষ করে আসলে লজ্জাকেই লজ্জিত করেছেন যিনি তিনি, হ্যাঁ তিনিই আমাদের এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী- এইভেবে সঙ্কোচে কুঁকড়ে যাবেন না যেন। তারচেয়ে বরং তাড়াতাড়ি করোনাকে পাশবালিশ করে ঘুমোনো অভ্যাস করে ফেলুন। মনে রাখবেন আমাদের মুখ তাকিয়ে করোনা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ার যোগ্য সব কাজ যত্ন সহকারে শেষ করার পরেও কখনো ডাক্তার, কখনো নার্স, কখনো পুলিশ আবার কখনো সহকর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে দমকল কর্মীদের বিক্ষোভে বিধ্বস্ত, সত্য চাপা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত দৃশ্যত নাস্তানাবুদ আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর করোনার হাত থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে এটাই শ্রেষ্ঠ এবং শেষ উপদেশ রাজ্যবাসীর কল্যাণে। চক দিয়ে বৃত্ত আঁকা দিয়ে শুরু করে করোনা মোকাবিলায় যে পবিত্র কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের তিনি সূত্রপাত ঘটিয়ে ছিলেন সেই করোনাকেই পাশবালিশ করে ঘুমোনোর উপদেশ দিয়ে সেই তিনিই, সেই মহান ব্রত ও কর্তব্য পালনের বৃত্তটিকে সম্পূর্ণ করলেন। এই যথার্থ উপদেশ যদি আপনি উপেক্ষা করেন, অবহেলা করেন এবং সেই কারনে অমান্য করেন তাহলে আপনার সামনে একটাই পথ খোলা,“চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ / প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, / এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি— / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। / অবশেষে সব কাজ সেরে / আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে / করে যাব আশীর্বাদ, / তারপর হব ইতিহাস।” মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। দেখুন কি করবেন।
—————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।