কলমের খোঁচা

প্রগতিশীল সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


বিশেষ প্রতিবেদন, গৌরী সেনগুপ্ত: চিন্তন নিউজ:১৫ই সেপ্টেম্বর – একজন প্রকৃত সমাজসচেতন নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকোত্তর প্রতিভাবান যথার্থ মননশীল একজন জীবনশিল্পী হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । ১৮৭৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে তাঁর জন্ম । মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং ভূবনমোহিনী দেবীর জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন শরৎচন্দ্র । শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অসম সাহসী । সাঁতার কাটা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল, গাছে উঠে খেলা করা সেখানেই ঘুমিয়ে পড়া, জলাজঙ্গলে নদীর ধারে মাঠে-ঘাটে ছিল তাঁর নিত্য আনাগোনা । পশুপাখি কীটপতঙ্গ পুষতে তিনি ভালোবাসতেন ; খেলাধুলা ,ব্যায়ামেও তাঁর শখ ছিল । তাঁর সময়ে দুরন্তপনার জুরি ছিল না তাঁর । দেবানন্দপুরের অদূরে সরস্বতী নদী শরৎচন্দ্রের মনকে উদাস করে দিত । জেলেদের খেয়া পারাপারের নৌকা নিয়ে নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানো তাঁর নেশা ছিল । এরকম নদীর বুকে ঘুরতে ঘুরতে কৃষ্ণপুর নামে একটি গ্রামে একটি আখড়াবাড়ি আবিস্কার করেছিলেন , ঐ আখড়াবাড়িতে কিশোর শরৎ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন । আখড়ার গান শোনা তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল । এইভাবে শুরু করেছিলেন তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রা । চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে ট্রেনের হুইশেল তাঁকে অন্য দেশে পৌঁছে দেবার নিশানা দিত । নিদারুণ দারিদ্রতার প্রকোপের মধ্যে শরৎচন্দ্র তখন ফার্স্ট ক্লাশে পড়েন ( সালটা ১৮৯২ ) আঘাতে এবং ব্যথার অভিঘাতে শরৎচন্দ্র বুঝেছিলেন চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকলে চলবে না , বুঝতে হবে বিশ্ব সংসারকে । ছেলের স্কুলের মাইনে দেবার সামর্থ নেই মতিলালের তাই তাঁর স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে গেল , শরৎচন্দ্রের বয়স তখন সতেরো । তাঁদের চলে যেতে হল ভাগলপুরে মাতুলালয়ে । সেখানে গিয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করেছিলেন , বহু বিঘ্ন থাকা সত্বেও তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় স্থান অধীকার করেছিলেন । তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর । সেইসময় ‘বাসা’ নামে একটি উপন্যাসও রচনা করেছিলেন । এরপর শরৎচন্দ্রকে টিউশন করে পড়া চালিয়ে যেতে হয়েছিল । বইপত্র চেয়ে নিয়ে তাঁকে পড়াশোনা করতে হত । খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করে নিতেন । অস্বাভাবিক মেধা থাকা সত্বেও দারিদ্রের নিপীড়নে কলেজে লেখাপড়া চালাতে পারেননি তিনি । এর মধ্যে মাতা ভূবনমোহিনী দেবীর মৃত্যু হল । মায়ের মৃত্যুতে শরৎচন্দ্র অত্যন্ত শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তবু গানবাজনা,অভিনয়, খেলাধুলা নিয়ে দিন কাটতো তাঁর । ভাগলপুরের নির্ভীক পরোপকারী এক আশ্চর্য যুবক ছিলেন রাজেন মজুমদার । পরবর্তীকালে এই যুবকই হয়েছিলেন শরৎসাহিত্যের আকর্ষণীয় চরিত্র ইন্দ্রনাথ । ভয় ভক্তি ও ভালোবাসায় এই রাজেন্দ্র শরৎচন্দ্রের অন্তরে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল । এর কাছেই শরৎচন্দ্র শিখেছিলেন পৃথিবীতে ভয় বলে কিছু নেই । এই বন্ধুর সাহায্যেই তিনি জেনেছিলেন নদী নৌকা বনজঙ্গল মাঠ অন্ধকার নির্জনতা এসবকিছু আপনার জন । শ্রীকান্ত পড়েছেন অথচ ইন্দনাথকে চেনেন না এমন পাঠক নেই । এই দুরন্ত কিশোরের সহচর ছিলেন তিনি । গভীর রাত্রে নিস্তব্ধ নিঝুম নদীর তীর ঘেঁসে সন্সন্ ডিঙি নৌকায় জেলেদের চোখে ধুলো দিয়ে মাছ চুরি করে আস্তানায় ফিরে আসা ছিল এই দুই কিশোরের নিশীথ অভিযান ।
বাস্তব অর্থে শরৎচন্দ্র ছিলেন একজন প্রগতিশীল সাহিত্যিক যেখানে তিনি সমাজসংস্কারক এবং সার্থক পথপ্রদর্শক । সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল পরিবেশে যখন এক গণজাগরণের প্রেক্ষাপট ঠিক তখনই শরৎ সাহিত্যের আবির্ভাব । স্বাভাবিকভাবেই তাঁর চিন্তাচেতনা সংস্কারবিরোধী আপসহীন বিপ্লবাত্মক সর্বোপরি মানবতাবাদী ।

শরৎ-সাহিত্যে অধ্যাত্মবাদী চিন্তাভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি । অতিপ্রাকৃতবাদের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম কখনও আপস করেনি । আমাদের দেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রই একমাত্র সাহিত্যিক যিনি তখনকার দিনে সমাজবিপ্লবের ঝাণ্ডাকে উর্ধে তুলে ধরেছিলেন, সমাজবিপ্লবের কর্তব্য সম্পন্ন করার জন্য একনিষ্ঠভাবে লড়েছেন তিনি । স্বাভাবিকভাবে সাহিত্যজগতে তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন । তদানীন্তন পুরনো সমাজের কর্তাদের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে শরৎচন্দ্রের ওপরে । হিন্দুসমাজের মৌলবাদীরা শরৎচন্দ্রের বিরোধী ছিল । এককথায় বাংলার সমাজের মাটিকে ছুঁয়ে মানুষের চরিত্র পরিবর্তন করবার জন্য যে সাহিত্য হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তার পুরোনো আচার ও রীতিনীতিগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করেছে তা হচ্ছে শরৎ সাহিত্য এবং শরৎচিন্তা । অপরদিকে সাহিত্যরস সৃষ্টিতে শরৎচন্দ্র ছিলেন একজন উচ্চমানের শিল্পী । অত্যন্ত উচ্চমানের ক্ষমতায় তিনি এমনভাবে সাহিত্যে উপাদান বিছিয়ে দিতেন যে পাঠক কিছু না বুঝেই সাহিত্যরস গ্রহণ করতে করতেই পালটে যেতেন । মেয়েরা হেমাঙ্গিনী বা নারায়ণীর মত হতে পারুক আর না পারুক ঐ চরিত্রগুলির মত হওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা জাগবে । শরৎ সাহিত্যে কিরণময়ী, সাবিত্রী, রমা এইসব চরিত্রগুলি উপস্থাপনায় যেমন পাঠকমনে বেদনা এনেছে তেমনি সমাজমানসিকতায় যে কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা রয়েছে তাকে ভাঙতে চেয়েছে । নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতার বিকাশ , মর্যাদাবোধের বৃদ্ধি চারিত্রিক উন্নতি আজকের সমাজে আশু প্রয়োজন । নারী প্রগতির আন্দোলনের বিষয়গুলোকে শরৎ সাহিত্যে স্পষ্ট করে দেখা যায় । ‘পথের দাবী’তে শরৎচন্দ্র শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ গড়ে তুলেছেন । তৎকালীন সময়ে সাহিত্যচিন্তার ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র ছিলেন একজন সেক্যুলার হিউম্যানিস্ট । বিপ্লবাত্মক মানবতাবাদের উত্তরসাধক ছিলেন শরৎচন্দ্র । তাই তিনি ‘সব্যসাচী’র মুখ দিয়ে স্পষ্ট বলেছেন –“ সমস্ত ধর্মই মিথ্যা—আদিম দিনের কুসংস্কার । বিশ্বমানবতার এতবড় পরম শত্রু আর নাই ।”একজন সমাজদরদী শিল্পী যখন সাহিত্যের অঙ্গনে বসে আলো দেখান তখন তিনি তাঁর জীবনের রসদ সংগ্রহ করেন সমাজের আঙিনা থেকেই । এখানেই শরৎ সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।