বিশেষ প্রতিবেদন: মধুমিতা ঘোষ:চিন্তন নিউজ: ২৬/১১/২০২৩:- তুর্কির কমিউনিস্ট পার্টি ( টিকেপি)র ব্যবস্থাপনায় গত ১৯ থেকে ২৩ শে অক্টোবর সে দেশের ইজমির প্রদেশে বিশ্বের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পাটিগুলোর এক আন্তর্জাতিক আলোচনা সভার ২৩ তম অধিবেশন হয়ে গেল। এই বছর তুরস্কে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। আর সেখানে মেহনতী জনসাধারণ প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান শোষণ ও দারিদ্র্যের সাথে লাগাতার যে লড়াই করে চলেছে সেদিকে নজর দিয়ে এবং শতবর্ষ আগে সাম্রাজ্যবাদী সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তুরস্কের কমিউনিস্টদের সংগ্রামকে কুর্নিশ জানিয়ে ২৩ তম আন্তর্জাতিক বৈঠকের জন্য তুরস্ককে নির্বাচন করা হয়। ৫৪টি দেশের ৬৮ টি পার্টির পক্ষ থেকে মোট ১২১ জন প্রতিনিধি এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন কারণে সাতটি পার্টি সরাসরি এই আলোচনায় উপস্থিত থাকতে না পারায় শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ( মার্কসবাদীর) পলিটব্যুরো সদস্য ও পার্টির তরফে আন্তর্জাতিক বিষয় সমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমরেড এম এ বেবি ওই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে আলোচনার মূল বিষয় ছিল: সারা পৃথিবী জুড়ে ধনতন্ত্রবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বাড়াবাড়ি রকম ঢক্কা- নিনাদের অন্তঃস্থল থেকে শোষিত, নিপীড়িত মেহনতী ও সব শ্রেণীর মানুষ, মহিলা, যুবসমাজ এমনকি বুদ্ধিজীবীদেরও কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত সংগ্রামে সামিল করতে সব দেশের পাটিকে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমজীবী সহ সর্বসাধারণের জন্য সামাজিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার গুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং বর্তমান বিশ্বের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শান্তি ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে যে কোনো রকম সামরিক অভিযান ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে ফলপ্রসু কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
৫ দিনব্যাপী দীর্ঘ আলোচনায় কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পাটিগুলোর আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিভিন্ন গণ আন্দোলন পরিচালনা করবার নানান অভিজ্ঞতার কথা সামনে এসেছে। বিশেষত গর্বাচেভ উত্তর রাশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা বদল ও পরবর্তীতে এই শক্তি সেখানে নিষ্প্রভ হওয়ায় বিশ্ববাজারে তথাকথিত পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাসে স্বাভাবিক জনজীবন যেভাবে বিপর্যস্ত, বিশ্বের সর্বত্র অসাম্য, দারিদ্র, বেকারিতে জর্জরিত মানব সমাজ যেভাবে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব, সংঘাত এমনকি বিপদজনক যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে তা আধুনিক দুনিয়ার মানুষকে সমাজবাদ ঠিক না সাম্রাজ্যবাদ- এই প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করায়।
আজকের বিশ্বে ধনতান্ত্রিক দেশগুলির মিলিত আস্ফালনে উদ্ভূত সাম্প্রতিক রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক বাস্তব পরিস্থিতির বিষয়ে মতবিনিময় ও পর্যালোচনা হয় যেখানে বিভিন্ন দেশকে বিপাকে ফেলতে ন্যাটোর ভূমিকার তীব্র নিন্দা সহকারে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নিন্দা আলোচনায় উঠে আসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্যালেস্তাইনের অমানবিক সাম্প্রতিক পরিস্থিতি , যেখানে গাজা উপত্যকা ইসরাইলি বর্বরোচিত সেনা অভিযানের নারকীয় গণহত্যা লীলার শিকার। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এমন জঘন্য কাজও সভ্যতার ইতিহাসে পুঁজিবাদ ও সহযোগী দেশ গুলির সমর্থন আদায় করে নেয়। অধিবেশনে উপস্থিত প্রতিনিধিগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইজরায়েলী সমর্থনের বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ হন। অবিলম্বে ইসরাইলি দখলদারি শেষ করে, জেলবন্দি সমস্ত নাগরিকদের রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে মুক্তি দিয়ে, যাবতীয় অবৈধ কর্তৃত্ব খারিজ করে স্বাধীন প্যালেস্তাইন কে এক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদানে ঘর ছাড়তে বাধ্য হওয়া উদ্বাস্তু জনসাধারণের ঘরে ফেরা সুনিশ্চিত করতে হবে, এই বিষয়টি আলোচিত হয়। দুনিয়ার সব সাধারন মানুষের সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত ও শক্তিশালী করবার লক্ষ্যে প্যালেস্টাইনের জনসাধারণের লড়াইকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে এক আন্তর্জাতিক সংহতি নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
বিভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ন্যাটোর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরো জোরদার করার বিষয়ে সকলেই একমত ছিলেন।
আজকের বিশ্ব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা সাধারণের সামনে তুলে ধরতে বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে সমস্ত শ্রেণীর জনগণের দৈনন্দিন সংগ্রামের বিভিন্ন দাবীগুলো সঙ্গে নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলোকে আন্তর্জাতিকতাবাদ এর ভিত্তিতে আরো শক্তিশালী ও একত্রীভূত করতে হবে। সমাজতন্ত্রের সুরক্ষায় কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি ও সেদেশের জনগণের একযোগে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও সেই বিপ্লবের সাফল্যগুলোকে বারংবার জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে হবে। এই বৈঠকের আলোচনায় পরিষ্কার হয়েছে যে সারা পৃথিবী জুড়েই একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যৌথ দুরভিসন্ধিমূলক বিভিন্ন প্রয়াস যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, সংবাদপত্রে মিথ্যা ভাষণ, দমনমূলক শাসনব্যবস্থা ইত্যাদির দাপট মেহনতী মানুষদের ঐক্যের পথে, সংগঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রায় পুরোপুরি বাধা দানে সফল হয়েছে। এর প্রতিরোধে বুর্জোয়া মিডিয়া ও শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত সংগ্রাম নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে হবে, যাতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই মজবুত হয়। আলোচনার সময় একাধিক প্রতিনিধি তুরস্কে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সে দেশের শ্রমজীবীদের লড়াইতে সহমর্মিতা জানিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সারা পৃথিবীব্যাপী কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পাটিগুলো আগামী বছরের আগেই এক সংহতি মূলক ও ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির রূপরেখা নির্মাণ করবে বলে এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
১৯ থেকে ২৩ শে অক্টোবর তুর্কির ইজমির আয়োজিত কমিউনিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর আন্তর্জাতিক বৈঠকের ২৩ তম অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব: (১)গাজা ও পশ্চিমতীরে ইজরায়েলের আগ্রাসন ও অবরোধ এখনই বন্ধ করতে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণকে সংগঠিত সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। ইজরায়েলের নির্লজ্জ আক্রমণে সমর্থনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং ব্রিটেন সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিকে এই সম্মেলন তীব্র ভাষায় ধিক্কার ও নিন্দা জানাচ্ছে।
(২) যাবতীয় দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে অনতিবিলম্বে প্যালেস্টাইনকে স্বাধীনতা প্রদান ও জাতিসংঘের আলোচনায় গৃহীত ১৯৪ নম্বর প্রস্তাবনা অনুযায়ী শরণার্থীদের ঘরে ফেরাতে হবে।
(৩) আন্তর্জাতিক বৈঠকের ২৩ তম অধিবেশনে উপস্থিত কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পাটিগুলো ইজরায়েলের আক্রমণ প্রতিহত করতে, নির্বিচারে গণহত্যা বন্ধ করতে প্যালেস্তিনীয় জনসাধারণের সংগ্রামের প্রতি এক কার্যকরী সংহতি পালনের অঙ্গীকার করছে।