কলমের খোঁচা

রবীন্দ্র ভাবনায় নারীর স্থান।


কল্পনা গুপ্ত, চিন্তন নিউজ:৮ই মে: নারী-পুরুষের সনাতন জাত জাতিভেদ শুধু শারিরীক দিক দিয়েই নয় এই তারতম্যের প্রধান কারণ ছিলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সমাজে মেয়েদের বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে যা শুধু প্রাচ্যে নয় পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতেও ছিলো। নারীর প্রতি বৈষম্য নিয়ে প্রথম মাথা ঘামান সমাজ সংস্কারকরা। সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বালবিধবা, কুলীন প্রথার মতন বর্বর প্রথা ইত্যাদি নারীর হীন অবস্থার জন্য দায়ী ছিলো। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত মানুষেরা তাঁদের অনলস সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ প্রথার শাস্ত্রীয় সমর্থন জুগিয়ে এই হীনাবস্থা থেকে আইনি সমর্থনের পথে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছিলো।

রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন ১৮৬১ তে সতীদাহ বিরোধী আইনের ৩২ বছর ও বিধবা বিবাহের(১৮৫৬) আইনের ৫ বছর পর। তাঁর জীবনের প্রথমাংশে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাবে অনেকটাই প্রাচীণ সংস্কারের পথ ধরেই তাঁকে হাঁটতে হয়েছিল। তাঁর নিজের বিয়ে হয়েছিল বালিকা ভবতারিনীর সাথে, যাকে ঘন ঘন সন্তানও ধারণ করতে হয়েছিলো। তিনি তাঁর কন্যাদেরও কম বয়সেই বিয়ে দেন। পিতার ন্যায় তিনিও বিধবা বিবাহের সমর্থক ছিলেন না। পরে অবশ্যই এই গোঁড়ামি কাটিয়ে উঠেছিলেন এবং পুত্র রথীন্দ্রনাথের সাথে বিধবা প্রতিমাদেবীর বিয়ে দেন।

পরিণত ও বিদগ্ধ, মননশীল কবি বিগতকালকে আগামী কালের সঙ্গে যুক্ত করার চেতনায় দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে আমাদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল মানুষ শিক্ষা, চিন্তা, সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারলে বিভেদের সীমারেখাও আপনা হতেই ভেঙে পড়বে। তাঁর মানবধর্মী মনই নারীকে বিশাল কর্মকান্ডে যুক্ত করতে উৎসাহী। তাই তাঁর আহবান,’ এসো ছেড়ে,এসো সখী কুসুম শয়ন/বাজুক কঠিন মাটি চরণতলে’, (কড়ি ও কোমল)
নারীর মনুষ্যত্বে কবি লখেছেন- ‘…..আমাদের দেশেও কৃত্রিম বন্ধন্মুক্ত মেয়েরা যখন অপন, পূর্ণ মনুয্যত্বের মহিমা লাভ করবে তখন পুরুষও পাবে আপন পূর্ণতা। ‘ রবীন্দ্রনাথ মনে করেন ‘ নারীকে পূর্ণ শক্তিতে আজ মেয়ে হ’তে হ’লে তার সমস্ত মানসিক শক্তির পূর্ণ বিকাশ আবশ্যক। ‘
শ্রেণি বৈষম্য – কুসংস্কার – অশিক্ষা – অর্থনৈতিক পরাধীনতার বেড়াজালে মেয়েদের অভিশপ্ত বন্দীজীবন যাপন। এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে নারীকে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাওয়ার আকাঙ্খাকে এক অসমসাহসিকতার পরিচায়ক বলেই বোধহয়।
লাঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর অন্তর্বেদনা থেকেই বঞ্চিত নারীসমাজকে যাবতীয় মর্যাদা ও অধিকারে প্রতষ্ঠিত করার আকাঙ্খা জাগ্রত হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া ভ্রমণ করে এসে তাঁর মত ছিলো- ‘ আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলেছে।’

কবির রচনায় নারী প্রথমপর্বে এসেছে অধরা মানসী রুপে। তারপর তাঁর লেখায় নারী দ্বিধা দ্বন্দে ক্ষতবিক্ষত বাস্তবের মাটিতে দাঁড়াতে শিখেছে, তারপরে নারী বিড়ম্বিত জীবনের বোঝা টেনে নিতে নিতে প্রশ্ন করতে শুরু করছে। তাঁর রচনার কিছু অংশে আমরা পাবো বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ সীমায় পুরুষের সমান সম্মানে আগ্রহী নারীর নির্ভীক আত্মপ্রকাশ।
‘….পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি/ ছিন্ন পালের কাছি,/মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব/তুমি আছো, আমি আছি’। (নির্ভয়)
নারীর আত্মোপলব্ধি ও তার প্রকাশকে মর্যাদা ও স্বাধীনতা দিয়েছেন তাঁর রচনায়। রবীন্দ্র সাহিত্যে স্নিগ্ধোজ্জ্বল নায়িকা লাবণ্য। অমিত রায়ের সঙে বিবাহ পর্বে প্রবেশের ঠিক পূর্বে কেতকী মিত্র আর শোভনলালের আবির্ভাব। পরিণামে লাবণ্য – শোভনলালের, অমিত-কেতকীর মিলন। লাবণ্যের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে আর আছে সংস্কৃতির আভিজাত্যপূর্ণ প্রখর বুদ্ধিদিপ্তী। সে বলে- ‘ মোর লাগি করিয়ো না শোক/ আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক/ মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই/শূন্যেরে করিব পূর্ণ এই ব্রত বহিব সদাই/….হে বন্ধু বিদায়।’
কবির কাঙ্খিত সাধারণ মেয়েটি গৃহের,সমাজের গন্ডি ভেঙে পাড়ি দেয় দূরদেশে যেখানে- ‘…. যারা বিদ্বান/যারা বীর,/ যারা কবি, যারা শিল্পী, যার রজা/দল বেঁধে আসুক ওর চারদিকে।’ আবার ১৯১৪ এ প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু, এই সময়ে স্ত্রীর পত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে পারিবারিক আভিজাত্যকে মিথ্যা করে দিয়ে শুধুমাত্র মানবিকতাকে ভর করেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মেজোবউ মৃণাল।

দেনাপাওনার নিরুপমা পণ ও যৌতুকের বিরুদ্ধে এক প্রতবাদী চরিত্র। ঘরে বাইরে উপন্যাসে বিমলার চরিত্র চিত্রণের মধ্য দিয়ে তিনি সমসাময়িক কালকে অনেকদূর অতিক্রম করে গেছেন। বিমলাকে তিনি ঘিরের বাইরে টেনে এনে তার কাছে শিক্ষা- সৃংস্কৃতি -রাজনীতি- স্বদেশীকতার দরজাগুলি একে একে খুলে দিতে চেয়েছেন।

রক্তকরবীর নন্দিনী যখন রাজাকে জানায় – ‘আলোতে বেড়িয়ে এসো, মাটির উপর পা দাও, পৃথিবী খুশি হয়ে উঠুক।’ তখন সর্বজন শুভাকাঙ্ক্ষিনী এক নারীমূর্তিকে দেখি যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধে স্থির অবিচল। নন্দিনী শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। কবির জীবনের শেষপ্রান্তে তাঁর কাঙখিত নারীর প্রশ্ন- ‘শুধু শূন্যে চেয়ে রব? / কেন নিজে নাহি লব চিনে সার্থকের পথ? ‘

তাঁর কল্পিত মহিয়সী নারী নবজাগরণের আলোকে উদ্ভাসিতা দীপ্তিময়ী। আজকের নারীমুক্তি আন্দোলনেও রবীন্দ্রভাবনা প্রেরণাস্বরূপ, তাই আজো তাঁর লেখা সময়ের গন্ডি পেরিয়ে প্রাসঙ্গিক। কবির ভাষাতে বলতে হয় – ‘ নুতন সভ্যতার কাজে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে- প্রস্তুত হচ্ছে তারা পৃথিবীর সর্বত্রই।’ আর মেয়েদের প্রতি তাঁর উপদেশ বাণী,’তাঁরা যেন মুক্ত কিরেন হৃদয়কে,উজ্জ্বল করেন বুদ্ধিকে, নিষ্ঠা প্রয়োগ করেন জ্ঞানের তপস্যায়। মনে রাখেন, নির্বিচার অন্ধ রক্ষণশীলতা সৃষ্টিশীলতার বিরোধী। সামনে আসছে নূতন সৃষ্টির যুগ। সেই যুগের অধিকার লাভ করতে হলে মোহমুক্ত মনকে সর্বতোভাবে শ্রদ্ধার যোগ্য করতে হবে,অজ্ঞানের জড়তা এবং সকল প্রকার কাল্পনিক ও বাস্তবিক ভয়ের নিম্নগামী আকর্ষণ থেকে টেনে আপনাকে উপরের দিকে তুলতে হবে।’ ( নারী- কালান্তর)


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।