কলমের খোঁচা

বিজ্ঞান মনষ্ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মিতা দত্ত: চিন্তন নিউজ:৮ই মে:– বাঙালির জীবনচর্চায় সচেতন বা অবচেতন ভাবে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ।তিনি মিশে আছেন সুখে, দুঃখে আনন্দ,বেদনায়, শ্রমে, মননে। তাঁকে নিয়ে চর্চা নতুন নতুন দিগন্তের সন্ধান দেয়,উন্মোচিত করে নব,নব অন্বেষণের দরজা।

রবীন্দ্র সৃষ্টির মতোই রবীন্দ্র চর্চার বিস্তৃতি বিশাল সমুদ্রের মতো। আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তাঁর বিভিন্ন কাজে ও লেখায় বিজ্ঞান মনষ্কতা প্রতিভাত হয়েছে তা সাধ্যমতো তুলে ধরা। বিজ্ঞান মনষ্কতার অর্থ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনার মধ্যে যুক্তিবোধের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে সেই বার্তায় দিয়ে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিটি কাজে মানুষকে ধরতে চেষ্টা করে গেছেন। মানুষকে অপরাজেয় শক্তিতে দেখেছেন তাঁর সমস্ত কাজ, লেখা দিয়ে মানুযের জয়গান গেয়ে গেছেন। তাই তিনি জীবনের শেষ লগ্নে এসেও মানুষকে ছেড়ে যেতে চান নি। “মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। “তাঁর যুক্তিবাদী মন ইহলোককেই গুরুত্ব দিয়েছে।

যে কোনো সমাজকে আত্মপরিচয় খুঁজতে হয় তাঁর ইতিহাসের মধ্যে- ভারতীয় সমাজ পুর্নগঠন উদ্যোগে এই সত্যটি রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি ইতিহাসের গভীরে ভারতবর্ষকে দেখেছেন যা বিজ্ঞানমনষ্কতার অন্যতম দিক।রবীন্দ্রনাথের মতে ,ভারতের ক্ষেত্রে সমাজ গঠন প্রাথমিক, রাষ্ট্রগঠন তার পরে।তাঁর মতে উন্নয়নের প্রথম সোপান সামাজিক উন্নয়ন সামাজিক উন্নয়ন।

দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনে বিভ্রান্ত ভারতীয়দের সামনে তিনি আত্মনির্ভরশীলতার আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত করেছেন। তিনি চরম সত্যটি তুলে ধরেছেন যে,ইউরোপ আর আমাদের দেশে জাতির সংজ্ঞা এক নয়।এ প্রসঙ্গে তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয়রা আদিম অধিবাসীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করেছে।অন্যদিকে ভারতবর্ষ সবাইকে ধারণ করে এক অত্যাশ্চর্য প্রকান্ড সমাজ গড়ে তুলেছে।

রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই ন্যাশনালিজম ধারণাটির কেন্দ্র হলো ঐক্য বা মিলন।সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে এই ঐক্য সঞ্চারিত হবে।তাই তিনি নিজে সামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে উদাহরন তৈরী করেন।আমাদের দেশে যে মান্ধাতার আমলে চাষবাস চলতো তার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন পৈত্রিক সূত্রে জমিদার হবার সুবাদে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তাই নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বন্ধু পুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে বিদেশে উন্নত কৃষিবিদ্যার পাঠ নিতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা ফিরে এসে বিজ্ঞানে সহায় মাটি পরীক্ষা, উন্নত জাতের বীজ,ট্রাক্টর প্রভৃতির কাজ শুরু করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “আজ শুধু একলা চাষিরা চাষ করবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে ,বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হবে ” এই বিজ্ঞান সহায় চাষ ভাবনার সঙ্গে তাঁর যুক্তিবাদী মন সমবায় প্রথার কথা ভাবেন ও বাস্তবায়ন করেন। তিনি আরো উপলব্ধি করেন কৃষির উন্নতির জন্য কৃষিব্যাঙ্ক প্রয়োজন যা চাষের উন্নয়নের সহায়ক হবে।তিনি কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন করেন এবং নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন।কৃষকরা যে কোনো প্রাকৃতিক দৃর্যোগে অনাহারে না থাকে তার জন্য ধর্মগোলা স্থাপন করেন ।প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা ও তার রূপায়ন যুক্তিবাদী মানসিকতা প্রকাশিত হয়।

শিল্পায়ন সবার কল্যাণ সাধন করুক এবং শিল্পায়ন হোক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে – এই বার্তা ই তাঁর বিভিন্ন লেখনীর ছত্রে ছত্রে রেখে গেছেন। শিল্পায়নেের ভূল ভাবনা যন্ত্র, তাই বিজ্ঞান মনষ্ক রবীন্দ্রনাথ মানুষের প্রয়োজন মতোও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে যন্ত্রের ব্যবহাররের কথা বলেছেন।রাশিয়ার চিঠিতে সেখানকার বিজ্ঞান মনষ্ক সমাজ গঠনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড।সেই শিক্ষা শুধু বিদ্যালয় শিক্ষা নয়, তিনি লোকশিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন।সারাজীবন ধরে সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন আর সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে। তাই তার সাধ “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।”
তিনি মানুষের হদয়জুড়ে আছেন কিন্তু বর্তমান শাসক শ্রেণীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনুষ্যসমাজের একটা অংশ পথভ্রষ্ট হচ্ছে ভুলে যাচ্ছে ভারতীয় ঐতিহ্য। তাই আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের বার্তা আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধু তাঁর জন্মদিনে নয় প্রতিদিনের জীবনচর্যায় মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।