রঘুনাথ ভট্টাচার্য: চিন্তন নিউজ:৮ই জুলাই:- করোনার আক্রমণ সারা পৃথিবীর সমাজ জীবন যাপনে ও মানসিকতার অন্দরে গভীর পরিবর্তন নামিয়ে আনছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসগুলি উল্টেপাল্টে গিয়ে নতুন মূল্যবোধ তৈরী হচ্ছে। পারস্পরিক সম্পর্ক যেভাবে বিন্যস্ত হয়ে উঠছে তা সত্যিই অভিনব।
নীতি দুর্নীতির ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে সাধারণ্যে। যা হাতের কাছে আসছে, তাই আত্মস্যাৎ করার প্রবণতা প্রবল আকার হয়ে উঠল। এখন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ চাইছে ‘যেন তেন প্রকারেন’ ভবিষ্যনিধি আহরণ করে নিরাপত্তা অর্জন করতে। এক অবসন্ন অচেতনতার ঘন ছায়াজালে যেন মানব চিত্ত আচ্ছন্ন।
বহির্বিশ্বের বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাকালে একই দৃশ্য। ‘ তিমিঙ্ গিলতি তিমিঙ্গিল।’ পর্য্যবেক্ষকরা হিসেব কষে বলছেন সারা পৃথিবীতে স্বৈরতন্ত্রের উত্থানের চিহ্ন পরিষ্ফুট। ভারতও ব্যতিক্রম নয়।আচ্ছন্ন মানবসত্ত্বা দেশকাল নির্বিশেষে তার স্বাভাবিক ন্যায় অন্যায় বোধ সম্পর্কে দিশেহারা।
‘হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ’ নামে বিখ্যাত মানবাধিকার রক্ষার কাজে স্বনিয়োজিত সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী সারা পৃথিবীতেই এই অসুখ আজ প্রকট। তাদের মতে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আজ গণতন্ত্রের পর্দার
আড়ালে এক নয়া দক্ষিণপন্থী স্বৈরতন্ত্রের উত্থান অবশ্যম্ভাবী । তাঁরা লিখছেন, -“এস্ট্যাব্লিশড অটোক্রাটস্ অ্যান্ড দেয়ার অ্যাডমেয়ারস আর কাউন্টি্ং উইথ দেয়ার ডিসরিগাডস ফর বেসিক (হিউম্যান)রাইটস” ( প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা ও তার পৃষ্ঠপোষকরা মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তাদের অশ্রদ্ধার অবস্থান চালিয়েই যাচ্ছে।)
দরিদ্র দুর্বল মানুষের ত্রাণের অর্থ-রসদ লুঠ হয়ে গেল চোখের সামনে।শাসকের তাপ উত্তাপ নেই। কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন( তাদের পরিচয়-‘ বামপন্থী’) গোষ্ঠী প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই বিপন্নতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে।তাঁরা ত্রাণরসদ সংগ্রহ করে বিতরণ করছেন। দুর্বল বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, যাতে তাদের মনোবল ক্ষীণ না হয়ে যায়। তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে , দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে লড়াই ,বিদ্রোহ সংঘটিত করছেন।
খুবই দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে, কায়িক ও মানসিক দুর্নীতির ভারে সমাজের গণতান্ত্রিক অবস্থান যার পর নাই দুর্বল। মনে হয় , মানুষের ইতিহাসের সেই সব কালা দিনগুলো যেন ফিরে এল। স্বৈরতন্ত্রের উত্থান, মাৎস্যন্যায়ের হ্রেসারব , অপরাধীস্বত্ত্বার বিস্ফোরণ যেন ঘরের দরজায় কড়া নাড়ায়।
মানবাধিকারের পরম শত্রু যে স্বৈরতন্ত্রের রমরমা, সে কথা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এবিষয়ে হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ সংস্থা তাদের ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তথা বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষে যে ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট – ২০১৯ প্রকাশ করেছে, তাতে তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, ‘অটোক্রাটিক লিডারস রেয়ারলি সল্ভ দি প্রবলেমস দ্যাট দে সাইট টূ জাস্টিফাই দেয়ার রাইস টু পাওয়ার, বাট দে ভু ক্রিয়েট দেয়ার লিগাসি অফ অ্যাবুস.অ্যাট হোম, দি আন- একাউন্টেবল গভর্মেন্ট দ্যাট দে লিড বিকামস প্রুভ টু রিপ্রেজেনশন,কোরাপশন অ্যান্ড মিসম্যানেজমেন্ট. সাম ক্লেম দ্যাট দি অটোক্রাটস্ আর বেটার অ্যাট গেটিং দি থিংস ডান ,বাট অ্যাস প্রায়োরিটিস দেয়ার ওন পাওয়ার দি হিউম্যান কস্ট ক্যান বী ইনোরমাস.
(Autocratic leaders rarely solve the
problems that they cite to justify their rise to power, but they do create their legacy of abuse. At home, the unaccountable government that they lead becomes
prove to repression, corruption and
mismanagement. Some claim that the autocrats are better at getting the things done, but as prioritise their own power, the human cost can be enormous.)
( স্বৈরাচারী নেতৃত্ব ,যে সমস্যা সমাধানের শপথ নিয়ে ক্ষমতায় বসে, কদিচিৎ সেই সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু তারা অবশ্যই তাদের ভ্রষ্টাচারের অধিকার হাসিল করে। শেষমেশ তাদের সরকারের দায়হীন শাসন দমন-পীড়ণ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থার সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে। কেউ কেউ দাবি করেন যে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন দ্রুত কার্য্যসাধন নিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু আসলে তারা তাদের স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাকেই অগ্রাধিকার দেয়, ফলে সম্পাদিত প্রকল্পে কর্মীদের উপর পীড়ণ সব সীমা ছাড়িয়ে যায়।)
কিন্তু মানুষ তো অমৃতের সন্তান। তারা শুধু ঘুমিয়েই থাকবে একথা অতি অবৈজ্ঞানিক। মানবসভ্যতার ইতিহাস যুগে যুগে কালে কালে সুষুপ্তির ইতিহাস নয়, জাগরণের ইতিহাস। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য উভয় সভ্যতাই এই অকাট্য সত্য স্বীকার করেছে। কেউ ভস্মের মধ্য থেকে জীবন-পাখীকে উঠে আসতে দেখে, আবার কেউ বলে ‘ অধর্মের অভ্যূথ্থান
হলেই আমি(মানুষ) নিজেকে সৃষ্টি করি।’
উল্লিখিত রিপোর্টটিতে একথা দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে যে, “সর্বতোভাবেই মানবাধিকারের পক্ষে এটা একটা অন্ধকারময় সময়। তবুও, একদিকে যেমন স্বৈরাচারী শাসকদের ও তাদের তল্পিবাহক কুচক্রীদের দল যারা
মানবাধিকারের অসন্মান করতেই অভ্যস্ত, সংবাদ-এর হেডলাইন অধিকার করছে, অন্যদিকে তেমনই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নিশানবাহকরাও দেশে দেশে নীরবে তাদের শক্তি বাড়িয়ে নিচ্ছে। যারা আজ জনসমর্থন আদায়ের আশায় মানুষের মধ্যে ঘৃণা , বিভেদ ও অসহিষ্ণুতা ছড়াচ্ছে, তারা নিজেদের অজান্তেই আগামী যুদ্ধে জয়ী প্রতিরোধকারীদের বীজ বপন করে যাচ্ছে। এই স্বৈরাচারী শাসকদের অতিসক্রিয়তাই আশু শক্তিশালী প্রতিআক্রমণের জমি তৈরী করে দেবে।”
মানুষের যে আত্মমর্যাদাবোধ তাকে মানুষ আখ্যা দেয় , সেই বোধ তার অস্তিত্ব। সেই বোধের অমর্যাদা তার সমগ্র সত্ত্বাকে বিদ্রোহী করে তোলে। তাঁকে সেই হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সে কৃতসঙ্কল্প হয়ে ওঠে। যারা আজ মনুষ্যত্বের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে ক্ষমতার দম্ভে তাঁরা পরাজিত হবেই, এই কথাটি ঐ রিপোর্টে প্রাঞ্জল ভাষায় বিন্যস্ত।
মধ্যপ্রদেশের এক গ্রামের একটি আপাত সাধারন ঘটনা দেখাল মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ তার মনের কত গভীরে প্রথিত। সেটাকে স্থানচ্যূত করার প্রচেষ্টা কত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
মধ্যপ্রদেশের ভিন্ জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। সে গ্রামের মেয়ে রোশনি ভাদোরিয়া। বাবা পুরুষোত্তম ভাদোরিয়া। কিছু জমি চাষ করে সঙ্সার চালান। আরও দুটি সন্তান আছে তার। রোশনি ২৪ কিলোমিটার দূরের একটি
স্কুলের ছাত্রী। রোজ সাইকেলে যাতায়াত। দশ ক্লাসের বোর্ড পরীক্ষায় ৯৮.৭৫% নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। এ খবর সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় চারিদিক থেকে অভ্যর্থনায় ভেসে যায় রোশনি ও তার পরিবার। সরকারি কর্তৃপক্ষও অভিনন্দন জানান। অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু পুরুষোত্তমবাবু সব সাহায্য প্রস্তাব বিনীত ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমে জানান , “আমি সরকারি সাহায্য
নিতে পারি,বা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে পারি, কিন্তু কোনো ব্যক্তিগত সাহায্য নিয়ে আমার ছেলেমেয়েদের পড়াতে চাই না। ” তিনি আরও বলেন, ” আমি কৃষক। জানি কী ভাবে তারা গাছ বড় করে তুলতে হয়। আমি চাই আমার ছেলে মেয়েরা আত্মমর্যাদাবোধ-এর গুরুত্ব যেন
সম্যক শিখতে পারে।আজ আমি ব্যক্তিগত সাহায্য গ্রহণ করলে , আমি আমার বাচ্চাদের কী করে সেই পাঠ শেখাব।”মেয়ে রোশনি বাবার এই সিদ্ধান্তে রীতিমত গর্বিত।
এই ছোট্ট ঘটনাটি থেকে বোঝা যায় দেশের আপামর জনসাধারণের মর্যাদা বোধের সুর কোন গ্রামে বাঁধা। কাজেই, ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট-২০১৯ – তে ফিরে এসে বলা যায় যে, যারা আজ অন্যায় মুনাফা করতে জনগনকে অমর্যাদা করে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে ,তারা এবং যারা সেই অন্যায়কারীদের মদত দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার করে , তাঁরা কেউই এর জ্বলন্ত প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাবেনা। সারা বিশ্বে এই প্রতিরোধ স্পৃহা
দানা বাঁধছে। সমাজে তার প্রতিফলন
অবশ্যম্ভাবী।
……. ততই বাঁধন টুটবে মোদের , ততই বাঁধন টুটবে।