কলমের খোঁচা

বিদায়, চির তরুণ


শান্তনু বোস: চিন্তন নিউজ:৪ঠা জুলাই,২০২২:– ষাটের দশকে আত্মপ্রকাশ। সত্তরের দশক, আশির দশক, নব্বইয়ের দশক সময় কালে জমজমাট চিত্র নাট্যের বানিজ্য সফল বাংলা ছবি আর পরিচালক তরুণ মজুমদার প্রায় সমার্থক হয়ে গেছিলো। তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই হাসিকান্না, সুখদুঃখ দিয়ে নিপাট করে বোনা চিত্র নাট্য। অসাধারণ রসবোধ সম্পন্ন সিনেমা। সমাজ ভাবনার গভীরতা যেমন থাকতো, তেমনই সহজবোধ্য ছিল গল্পের এগিয়ে চলা। ক্যামেরা দিয়ে গল্প বলায় তরুণ মজুমদারের ছিল সহজ সরল ভঙ্গি। এটাই ছিল তাঁর সৃষ্টির নিজস্বতা।

১৯৫৯ সালে উত্তম সুচিত্রা জুটির “চাওয়া পাওয়া” ছবি দিয়ে তরুণ মজুমদারের আত্মপ্রকাশ। বাংলা সিনেমায় যেন নতুন প্রানের সঞ্চার। তারপর একের পর এক বানিজ্য সফল ছবি। ১৯৬২ সালে প্রথম জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি, ছবি “কাঁচের স্বর্গ”। “পলাতক”, “নিমন্ত্রণ”, “সংসার সীমান্তে” (১৯৭৫), “গণদেবতা” — এই সব ছবি সাধারণ মানুষকে যেমন ছুঁয়ে গেছে তেমনই প্রশংশিত হয়েছে চিত্র সমালোচক মহলে। তরুণ মজুমদার পরিচালিত “বালিকা বধূ” (১৯৬৭), “কুহেলী” (১৯৭১) সেই সময়ে চলচ্চিত্র মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এখনও এমন অনেক প্রবীনকে দেখা যাবে, যাদের জীবনে দেখা প্রথম সিনেমা “শ্রীমান পৃথ্বীরাজ” (১৯৭৩)। “ফুলেশ্বরী” (১৯৭৪), “দাদার কীর্তি” (১৯৮০), “ভালোবাসা ভালোবাসা” (১৯৮৫), “পরশমণি” (১৯৮৮) ও “আপন আমার আপন” (১৯৯০) সিনেমা গুলি বাংলা চলচিত্রে এমন একটা নতুন ঘরানার জন্মদেয়, যে ঘরানার নাম তরুণ মজুমদার ঘরানা। যে কথা না বললে তরুণ মজুমদারকে স্মরণ করা অসমাপ্ত থেকে যায় সেটা হল, তাঁর সিনেমায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রয়োগ। সিনেমার প্রত্যেকটা দৃশ্য এবং প্রেক্ষাপটের সাথে মানানসই রবীন্দ্র সঙ্গীত। দাদার কীর্তি সিনেমায় চিত্র নাট্যের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার ব্যবহার আবার সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে “চরন ধরিতে দিও গো আমারে” আর ” এই করেছো ভালো নিঠুর হে”। “ভালোবাসা ভালোবাসা” সিনেমায় “গোপন কথাটি রবে না গোপনে”। গান আর চিত্র নাট্য যেন একে অপরের পরিপূরক।

সিনেমা তৈরিতে সহজ সরল ভাষায় সামাজিক বার্তা দেওয়া তরুণ মজুমদার, ব্যক্তি জীবনেও ছিলেন সহজ সরল এবং শক্ত মেরুদণ্ডের স্পষ্টবাদী মানুষ। রঙ্গিন জগতের মানুষ হয়েও, সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে কোনো দ্বিধা করতেন না। আপস করতেন না নিজের জীবন দর্শনের সাথে। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঘোষিত বামপন্থী। কোনো আড়াল আবডালের পরোয়া করেননি বামপন্থার বিপর্যয়ের সময়েও। শ্রদ্ধা প্রয়াত চিত্র পরিচালক শ্রী তরুণ মজুমদারকে। তাঁর জীবনদর্শন এবং দৃঢ়, আপসহীন সামাজিক অবস্থানের সামনে আপনার চলচ্চিত্র, আপনার জীবন দর্শন আগামীর পাথেয় হয়ে থাকবে। ইতিহাস আপনাকে চিরকাল স্মরণ করবে শ্রদ্ধার সাথে। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহে থাকবে না কোন ফুলমালা থাকবে শুধু কবিগুরুর গীতাঞ্জলি ও সি পি আই এম এর প্রতীক চিন্হ দেওয়া রক্ত পতাকা — মিছিল হবে না কোন । তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য মরনত্তোর দেহ দান করেছেন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।