কলমের খোঁচা রাজনৈতিক

ছাত্র রাজনীতি এবং ৩০ শে নভেম্বর – গৌতম রায়


নিউজ ডেস্ক:চিন্তন নিউজ:–৩০শে নভেম্বর দিনটি ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে একটি কালো দিন। ১৯৮৬ সালের এই দিনে স্বৈরাচারী এরশাদ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিলেন ।ছাত্রসমাজ মুসলিম জাতীয়তাবাদের আরোপিত মোহমুদগার থেকে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করে, অখন্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করেছিল ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ।

প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকরা শাসকের কালাকানুন ১৪৪ ধারা ভাঙতে যখন দ্বিধান্বিত, তখন ছাত্রসমাজই প্রথম সেই অর্গল ভেঙে বেরিয়ে এসে মাতৃভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করবার ভেতর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নানা অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ,বাঙালি বিদ্বেষী চিন্তা-চেতনাকে প্রথম চ্যালেঞ্জ করবার দুর্বার সাহস দেখিয়েছিল।

পরবর্তীকালে অখন্ড পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে( ‘৫৪ সালে) সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিভূ মুসলিম লীগকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে এই ছাত্রসমাজ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সামাজিক ,রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ,অর্থনৈতিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। আসাদুজ্জামানের আত্ম বলিদান উনসত্তরের আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।বস্তুত, ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই উনসত্তরের আন্দোলন স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে ।

মহান মুক্তিযুদ্ধ(‘৭১) সংগঠিত করবার ক্ষেত্রেও ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক ।সেই ছাত্র সমাজকে রাজনীতি বিমুখ করে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশ পরিণত করবার যে চক্রান্ত রাজাকার পুনর্বাসন কারীর জিয়াউর রহমান শুরু করেছিল, তাকেই একটা প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে স্বৈরাচারী এরশাদ ‘৮৬ সালের আজকের দিনে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন।

গণতন্ত্রের দুটি টিপে হত্যা করাই শুধু নয়, গণতন্ত্রের মানস কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের এরশাদ লিপ্ত ছিল। শেখ হাসিনা তাঁর গোটা পরিবারের শাহাদাত বরণের পর দেশে ফিরে যান। সেই সময় সেনা ও মৌলবাদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে, তাঁকে হত্যা করে ,বাংলাদেশ গণতন্ত্রকে একেবারে কবরে পাঠানোর সব ধরনের ষড়যন্ত্র এরশাদ করেছিল।এই ক্ষেত্র ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গোটা বিষয়টি জানার পর তাঁর অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ।

কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে বসে প্রণব মুখোপাধ্যায় গোটা বিষয়টি তখন তত্ত্বাবধান করেছিলেন ।এহেন এরশাদ ,গণতন্ত্রের মানস কন্যা শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্রের মসনদে অভিষিক্ত করার লক্ষ্যে ,বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের সংগ্রামকে যে ভয় পাবেন, তা নতুন কোন কথা নয় ।তাই এরশাদ এই কালাকানুনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিল।এরশাদের সেই সময়ের কীর্তিকলাপ এবং তাকে ঘিরে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ,গণতন্ত্র রক্ষায় বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধি পান্থজনের সংগ্রাম ,ছাত্র সমাজের লড়াই ,শওকত আলী তাঁর ‘দলিল ‘ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে অমর করে রেখেছেন ।

সময়ের পরিবর্তনে নিরিখে বাংলাদেশ আজ গণতন্ত্রের মুক্তাঙ্গনে পরিণত হলেও ,ভারতবর্ষের গণতন্ত্র আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ।রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তার সহযোগী প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা ,ভাষা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা র ধারক বাহকেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষমতায় থেকে ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান কে আজ সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি তথাকথিত রামলালার জমি বলে ,ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেবার পর ,ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজ সব রকম ভাবে একটা প্রান্তিক অবস্থানে বসবাস করছেন। এই পরিবেশের গোটা ভূগোল টাকে প্রলম্বিত করতে পশ্চিমবঙ্গের ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এক ধরনের সামাজিক প্রযুক্তি বলবৎ রয়েছে।

অতীতে পশ্চিমবঙ্গের ভূমি স্তরের প্রতিটি সামাজিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ মিনার পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবধারা, চিন্তা- চেতনা ,মুক্ত ভাবনার , চর্চার প্রসার , প্রয়োগ ছিল তা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে এখন একদম ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে।

‘৮৬ সালে এরশাদ শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে উদ্যোগ নিয়ে নিজের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল , সেই পথে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেঁটে চলেছেন। তিনি ক্ষমতায় আসবার পর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাঙ্গন গুলি তে সরাসরি রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলেও শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির ছাত্রসংগঠন ব্যতীত অন্য কোনো বাম ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনকে কার্যত প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে দেওয়া হয় না।

পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সংসদে কোনো নির্বাচন হয় না ।ছাত্র সমাজের দাবি-দাওয়ার বিষয়গুলি ,শাসক তৃণমূল নির্ধারিত তথা মনোনীত ছাত্র প্রতিনিধিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় ।তাই ছাত্র সমাজের প্রকৃত দাবি-দাওয়া ,সমস্যা কোনো অবস্থাতেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক থেকে শুরু করে রাজ্য সরকার , কারোর ই নজরে আসে না।

এইরকম এক দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন গুলির ধারাবাহিক আন্দোলনের জেরে অতিসম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছেন। এই নির্বাচনে বামপন্থীদের নিরঙ্কুশ বিজয়, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের শোচনীয় পরাজয় ,প্রমাণ করেছে, পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র সমাজ কি চায়।

ছাত্র সমাজের এই চাহিদার দিক থেকেই আজকের দিনে ছাত্র রাজনীতির গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস করার যে উদ্যোগ একদিন এরশাদ বাংলাদেশের বুকে নিয়েছিল , যে উদ্যোগ দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালাচ্ছেন ,সেই উদ্যোগকে সমূলে উৎপাটিত করবার শপথের ভেতর দিয়েই বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবেশকে আমাদের আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ।

আজকের এই কালো দিনটি যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তাঁদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দিক, তাঁদের অর্জিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ,ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ ,সম্প্রীতির মূল্যবোধ- যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেই ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই আমাদের সামগ্রিক ভাবে চর্চা করতে হবে ।গণতন্ত্র ধ্বংসে আইয়ুব- ইয়াহিয়া -খন্দকার মোশতাক- জিয়াউর রহমান- এরশাদ -খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী- অটল বিহারী বাজপেয়ী -নরেন্দ্র মোদি- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগের পারস্পরিক সম্পর্ক আর নৈকট্য কে আমরা যেন ভুলে না যাই।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।