শাশ্বতী ঘোষাল: চিন্তন নিউজ(ভ্রমণ কাহিনী), ২৯ শে ফেব্রুয়ারি: গত ১৯ শে ফেব্রুয়ারি সদলবলে আন্দামান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম, অনেকদিনের ইচ্ছাপূরণ এই আন্দামান ভ্রমণ। তাই আনন্দ ও উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
সমুদ্র যতই দেখা হোক সাধ বুঝি মেটে না। অপার ও অসীম বিস্ময়ে চেয়ে থাকা আর ভাবনার ডানায় ভর করে শুধু এগিয়ে চলা। তবে এখানে সমুদ্রের বুকে গড়ে ওঠা দ্বীপগুলিতে জনজীবনের প্রতি ছিল অসীম আগ্রহ।
আন্দামান -নিকোবর এর রাজধানী পোর্টব্লেয়ারে সেলুলার জেলের কথা ইতিহাসে পড়ে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে কে না থাকে। সুসভ্য ইংরেজ জাতির অসভ্যতার কাহিনী তার দেওয়ালে,প্রাঙ্গণে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেলুলার জেল। কি অকথ্য অত্যাচার যে তাঁরা সহ্য করেছেন তা শুনে ও দেখে (light & sound Show র মাধ্যম) চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠছিল। তবে খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন ,যখন দেখছিলাম ঐ ব্যথাভরা নিদর্শন গুলির সামনে হাস্যমুখে ছবি তোলার জন্য পোস দিচ্ছেন দেশোয়ালী ভাইবোনেরা।
দূর দ্বীপ বাসিনী (হোক না মাত্র এক সপ্তাহের) হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সমুদ্রের বুকে গড়ে ওঠা এক একটা দ্বীপে ভ্রমণের ইচ্ছা নিয়ে সুন্দরী আন্দামান ঘোরার বাসনা তৃপ্তি লাভ করেছে কোনো সন্দেহ নেই। দোদুল্যমান সমুদ্র বক্ষে স্টীমার, স্পীডবোট, লঞ্চে ভ্রমণের যে রোমাঞ্চকর অভিযান তা চিরকাল মনে থাকবে। তবে যেটা দেখে সবচেয়ে বেশি অভিভূত হই তা হলো লাইম কেভ –চুনাপাথরের গুহা।
ভ্রমণের শেষপর্বে অর্থাৎ শেষতম দিনটিতে আমরা বারাটাঙ্গ (baratang) র উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। এ যাত্রাপথটিও অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। রাত্রি দুটোর সময় ঘুম থেকে উঠে তিনটের সময় যাত্রা হলো শুরু। অন্ধকারে জঙ্গলের বুক চিরে চলেছে বাস। তার পেটের ভেতর বসে কুড়িজন। সামনে আরো বেশ কিছু গাড়ি ও চলেছে ঐ একই গন্তব্যে। দুঘন্টা পর বাস এসে দাঁড়ালো কোনো একটি জায়গায়। সেখান থেকে তৈরি হবে কনভয়। ড্রাইভারের দেওয়া তিনটি ফর্ম ফিল আপ করে আমরা নামলাম বাস থেকে। চা -এর দোকান বেশ কয়েকটি। চা খেলাম সবাই সেখানে। পুলিশি ভেরিফিকেশন চলছিল ততক্ষণ। প্রায় শ’দুয়েক গাড়ি মিলিত হলো এবং একঘন্টা পর অর্থাৎ সকাল ছ’টায় আবার যাত্রা শুরু হলো। এখান থেকেই জারোয়াদের অবস্থান। ঘন জঙ্গলের মধ্যে তারা থাকে। দেখতে যে পাবোই এমন কিছু নিশ্চয়তা নেই। ড্রাইভার নীলকণ্ঠ সতর্ক করে দিয়েছে ছবি তোলা যাবে না। চীৎকার চেঁচামেচি ও নিষিদ্ধ। ওরা যদি আড়াল থেকে এসব দেখে তাহলে সমূহ সর্বনাশ। বাস আটকে দেবে সবাই মিলে। অতএব স্পীকটি নট। চুপ করে বসে বড় বড় চোখ (যতটা সম্ভব আর কি) করে বসে আছি। যদি হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটে কারো। যখন আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি তখন ই বাস একটু স্লো করা হলো। দেখি আট-দশজন মিলে বসে আছেন তারা। ঘন কৃষ্ণবর্ণ না হলেও যথেষ্ট কালো তাদের গাত্রবর্ণ। কিঞ্চিৎ লজ্জাবস্ত্রে আচ্ছাদিত। মনে হলো হয়তো এরা কিছুটা হলেও মানুষের সংস্পর্শে এসেছে। একজন বোতলে জলও খাচ্ছিল। বিশেষ কায়দায় চুল কাটা। ওরা কিন্তু আমাদের দিকে ফিরেও তাকালো না।
দু ঘন্টার যাত্রা শেষে সকাল আটটায় আমরা এসে পৌঁছালাম সমুদ্র জেটিতে। সেখানে গিয়ে স্টীমারে চাপলাম। দুশোটা গাড়ির যাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার মত যথেষ্ট সংখ্যক স্টীমার ছিল সেখানে। সেগুলিতে বাস, কার সবই চাপানো হচ্ছিল। যাই হোক দশ মিনিট পর ওখান থেকে নেমে স্পীডবোটে চড়ে বসলাম এক একটা বোটে দশ জন করে। তরতর করে এগিয়ে চললাম। প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট পর সংকীর্ণ হয়ে এল জলপথ। অসংখ্য গাছের ডাল ঠিক মাথার উপরে। নিজের মাথা বাঁচানোর দায়িত্ব নিজেরই। প্রকৃতির রূপে উদাস হলে চলবে না। এরপর একটা বাঁশের সাঁকোর কাছে আমরা নামলাম। পরবর্তী গাড়িটি চরণ বাবুর। ভ্রমণ ক্লান্ত চরণকে কোনোমতেই বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া চলবে না। তবে এখানে আসার আগে কেউ বলেছিল তিন কিলোমিটার রাস্তা কেউ বা বলেছিল দু কিমি। দেখলাম দেড় কিমি থেকেও কম। তবে রাস্তা মোটেই সমতল নয়। গাছের শিকড় ,পাথর মাথা উঁচু করে বিরাজ করছে। যথেষ্ট সাবধানে পা ফেলতে হবে ।সময় সীমা নির্দিষ্ট। বড় বড় পা ফেলে যার সামনে এসে উপস্থিত হলাম তা যেন রূপকথার কোনো রাজ্য। সামনে চলে গেছে সংকীর্ণ পাথুরে পথ। দুপাশে বিশাল আকৃতির (কিছুটা বিশেষত ওপরের দিকটা দুধ সাদা আর নিম্নের কিছু অংশ কালো) রঙের দেওয়াল।ভ্রমণার্থীদের টর্চের স্বল্প আলোয় নীলাভ বর্ণ ধারণ করেছে সেই দেওয়াল। গাইডের কাছে জানলাম দু পাশের এই পাথরের দেওয়াল ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একটু একটু করে বড় হচ্ছে সেই গুহা।নীচের পাথর গুলোতে মানুষের হাত পড়ে যাওয়ার ফলে তাদের মৃত্যু ঘটেছে আর কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে। গাইড সতর্ক করেছিল ষাট শতাংশ পাথরের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে। বাকি চল্লিশ শতাংশের জীবনের ব্যাপারে আমাদের তাই অধিক সতর্ক থাকতে হবে। তবুও সংকীর্ণ পথে টালমাটাল আমি একবার হাত রেখে ফেলেছিলাম সে দেওয়ালে। মনে হলো কি একটা নরম চটচটে জিনিষে হাত লাগলো। পরক্ষণেই গাইডের কথা মনে পড়ে গেল। মন বড় বিমর্ষ হয়ে গেলো। আহারে আজ থেকে ঐ পাথরটিও স্থবির হয়ে যাবে। জীবন্ত পাথর গুলি নরম প্রকৃতির। পাথুরে কাঠিন্যর উপমা অন্তত তার ক্ষেত্রে চলবে না।
সাদা পাথরগুলির বেশ কয়েকটি চকচক করছে আলো পড়লে। কত রকম আকার যে তাদের। ‘যত তুমি ভাবতে পারো তার চেয়ে সে অনেক আরো ‘ কোথাও বিশালাকার মাছ, কোথাও হাতি বা গণেশের মুখ, কোথাও পরী। আসলে এই আকার গুলি অনেকটা আমাদের কল্পনা শক্তির বিস্তারের ওপরও নির্ভর করে।অপূর্ব সে দৃশ্য। নীলাভ স্বপ্নপুরী যেন। অপরিসীম ভালোলাগায় মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।
এরপর ফেরার পালা। পথে লেবু সরবতের দোকানে সরবত খেয়ে সজীব মন নিয়ে প্রায় উড়তে উড়তে পৌঁছে গেলাম স্পীড বোটের কাছে। এক অদ্ভুত ভালোলাগা, মনখারাপ মিলেমিশে একাকার করে দিল লাইম-কেভ। মনে এক রেশ রেখে গেল। থাকবে।