কলমের খোঁচা

টো টো করা জীবন গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ:২৫শে এপ্রিল:- সেই টোটোটা নিজের দোষেই একটু হলেও খুঁটি হয়ে গেল?
মনটা খচখচ করছে।মনের এই খচখচানি নিয়েই মনে পড়ল, যা জোরে গ্রিলের দরজাটার সঙ্গে টোটোটা ধাক্কা খেল আমার ই দোষে, দরজা টার আবার কোনো ক্ষতি হয় নি তো?
টোটোটা বাড়ির সামনের রাস্তায় রেখে হাঁটু মুড়ে দেখার চেষ্টা করলাম গ্রিলের দরজাটার হালটা।আর তখন ই টের পেলাম টোটো বা গ্রিলের দরজার মতোই হাঁটুতেও বেশ জোরেই লেগেছে।ব্যথার মালুম হলেও তখন ও আমার প্রথম লক্ষ্য হলো , গ্রিলের দরজার ক্ষয়ক্ষতি।বেশ নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখলাম , গ্রিলের দরজার আদৌ কোনো ক্ষতি হয় নি।এবার নজর পড়লো নিজের হাঁটুর দিকে।
হাঁটু টা বেশ ছড়ে গেছে।টোটো আর গ্রিলের দরজার কলিশনের ফেড়ে আমার জিন্সের প্যান্টের ডান হাঁটুর জায়গাটা খানিকটা ছিঁড়ে ও গেছে।তবে আজকালকার জেনারেশন ওয়াইজ স্টাইলে এই হাঁটু ছেঁড়া জিন্সের একটা আলাদা ইজ্জত আছে! এটা ভেবেই প্যান্ট ছেঁড়ার শোক সামলে জখম হাঁটুর দিকে নজর দিলাম।
অল্প কিছুদিন আগে কেনা টোটো, সেই টোটো রাখার জন্যে বাবার তৈরি করে যাওয়া বারান্দার শক্তপোক্ত দেওয়াল ভেঙে তৈরি গ্রিলের গেট, নিজের পরণের জিন্সের প্যান্ট– এইসব অনিত্যতার নিত্য উপস্থিতির জান্তব প্রমাণ ঠিকঠাক পাওয়ার পর অবশেষে নিজের আদি অকৃত্রিম হাঁটুটার দিকে আমার নজর পড়লো।
টোটো র রঙ চটেছে, জিন্সের প্যান্ট একটু ছিঁড়েছে- এসব ‘ সামান্য ক্ষতি’ কে উপচিয়ে আমার ছড়ে যাওয়া হাঁটু থেকে তখন কেবল রক্ত ই পড়ছে না, ফুলেছেও বিস্তর।
টোটোটা বাড়ির সামনে কোনো মতে রেখে ভেতরে গেলাম বরফ আনতে।
ও মা! ফ্রিজে এক টুকরো বরফ নেই।প্রাথমিক ঝাঁজ টা মায়ের উপর দিয়ে হাঁটুর ব্যথা কমাবার বৃথা চেষ্টা করেই মনে পড়ে গেল মায়ের শরীরের কথা।খাওয়া – দাওয়ার পর যে মানুষ টা মনে রাখতে পারে না খাওয়া হয়েছে, কি হয় নি, তাঁর কাছে তো ফ্রিজে বরফ জমার জন্যে জল কেন রাখনি বলে কৈফিয়ৎ চাওয়া যায় না।
আসলে ব্যথা , সেটা মনে ই হোক আর শরীরের ই হোক – নিকটজনের শৈথিল্য ঘিরে আবদার, অভিমানটাই বুঝি তখন মনের ভিতর ভিড় করে আসে।আর ঠিক তখন ই আমার মনে পড়ে যায়, আমার ই বৌভাতের দিন অনিরুদ্ধর কথা গুলো;
জানিস তো, বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়িটা আরো জ্যান্ত হয়ে উঠলেও ছেলেদের বাপের বাড়ি বলে আর কিছু থাকে না!
তখন আমার দুচোখ ঘিরে স্বপ্ন।তাই অনিরুদ্ধের কথা গুলো শুনে ওকে একটু স্যাডিস্ট গোছের বলেই মনে হয়েছিল।
বাবা তখনো রিয়াটার করে নি।কাস্টমসে চাকরি।ঘুষ নিতো , কি নিতো না বাবা, সত্যি কথা বলতে কি সেটা আমি আজ পর্যন্ত ঠিক ভালো ভাবে বুঝে উঠতে পারি নি।বাবার কোনো কোনো কলিগদের লাইফ স্টাইল দেখে ভাবতাম, ইশ , ওঁরাও তো বাবার মতোই চাকরি করে।বাবার থেকে খুব একটা হাই পোস্টে তো এঁদের কেউ ই প্রায় নেই।তাহলে আমরা এখনো কেন ভাড়া বাড়িতে থাকি? কেন আমাদের এখনো পর্যন্ত নিজেদের বাড়ি হলো না?
বড়দির বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে ই বাবা বাড়িটা কিনল।আমার আর ছোড়দি, দুজনের ই বেশ আপত্তি ছিল এই পুরনো বাড়ি কেনাতে।তার উপরে জুটমিলের লেবারদের পাড়াতে একটু সস্তাগন্ডা দেখে বাবার বাড়ি কেনাটা আমরা সত্যি ই তখন মন থেকে ঠিক ভালো ভাবে নিতে পারি নি।কেমন যেন মনে হতো প্রথম প্রথম এই পাড়াতে এসে।
বাবা যখন এ পাড়াতে বাড়িটা কিনলেন, আমার আর ছোড়দির পাড়ার লোকজনকে ঘিরে একটা উন্নাসিক ধারণা ছিল।নিজে তো তখন রোজগার করি না।বাপের পয়সায় ফুটানি করি।তাই পাড়ার গরীব চটকল লেবার দের দেখে নিজেদের ধরে নিয়েছিলাম টাটা, বিড়লাদের খুড়তোতো , মাসতুতো ভাই।
বাপের হোটেলে থাকার মজাটা কি জম্পেশ, সেটা যে না থেকেছে, সে বুঝবে না।জিন্স ফুঁড়ে ব্যথাটা একটু বেশি মালুম ই হচ্ছে।টোটোটা রাস্তায় সাইড করে রেখে বাড়ি ঢুকলাম বরফ দেওয়ার জন্যে।
যাঃ শাল্লা! ফ্রিজে এক কুচি ও বরফ নেই।ব্যথার ভিতরে ফ্রিজে বরফ না থাকার রাগ গিয়ে পড়ল মায়ের উপর।সুজাতা শ্যামপুরে মেয়েকে নিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকার পর থেকে মা যে একটা দিনের জন্যেও ফ্রিজ খোলে না- এ কথাটা আমার মাথা আনার প্রয়োজন ও তখন আমার নেই।
আচ্ছা, সুজাতাকে ঝারতে না পেরেই কি আমি মায়ের উপর এমন টা খেঁচিয়ে উঠলাম?আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় আঠারো, উনিশ বছর।মেয়ে পড়ে ক্লাস সেভেনে।হঠাৎ একটু পায়ে ঠোক্কর খেলাম।প্যান্টের পা ছিঁড়ে হাঁটু জখম হলো।একটু রক্ত ও পড়ছে।এমন সময়ে বৌয়ের একটু আহা , উঁহু প্রত্যাশা করাটা কি আমার একটু বেশি রকমের চাওয়া হয়ে গেল? আর অবচেতন মনের সেই চাওয়াটা না পেয়ে ই কি আমার বিষন্নতায় ভোগা মাকে সামনে পেয়ে, ফ্রিজে বরফ না থাকার সব দায় টা তাঁর উপরে চাপিয়ে দিলাম?
মাকে সময় নেই, অসময় নেই সব দোষে দোষী করতে পারলে সব বয়সেই সন্তান বুঝি একটু নিজের অক্ষমতার ব্যথাতে মলম দিতে পারে? তাই না? মা আমার কোনোদিন সাত পাঁচে থাকে নি।আজ তো থাকার প্রশ্ন ই ওঠে না।বাবার হঠাৎ মারা যাওয়ার আগে থেকেই মা ডিপ্রেশনে ভুগছে।মায়ের এই বিষন্নতা আমি তখন কি বুঝতাম না? নাকি বুঝেও বুঝতে চাইতাম না?
সুজাতা বলতো; তোমার মায়ের সবটাতে একটু যেন বেশি বশি।আমি তখন কি আমার আজন্ম চেনা মাকে একটু অজানা ঠাওরেছিলাম? মায়ের থেকে সুজাতাই কি আমার কাছে হয়ে উঠেছিল অনেক বেশি চেনা? সবটাতেই মার বাতিক।কনস্টিপেশন থেকে সুজাতা – সবাইকে নিয়ে মা অহেতুক বেশি ভাবে– এসব নিয়ে কেন কথাকাটি করেছিলাম বাবার সঙ্গে? বাবা ও খানিকটা মায়ের ই মতো ছিল।বাইরে কর্মজগতের হাজার ঝামেলা সামলে হাসি মুখে সংসারের জোয়াল টেনে গেছে।বড়দির বিয়ে দিয়েছে।ছোড়দির , আমার পড়াশুনা চালিয়েছে ।ভাড়া বাড়ির হাজারটা ঝক্কি সামলে সংসারের জোয়াল বয়েছে।একটা দিনের জন্যে কোনো টাকা পয়সার জন্যে কষ্ট বাবা আমাদের পেতে দেয় নি।তিল তিল করে জমানো টাকা দিয়ে এই বাড়িটা কিনেছে।সেই বাবার সঙ্গে মা কে নিয়ে বৌয়ের হয়ে কথা কাটাকাটি তে জড়িয়েছি!
আসলে এসব কিছু ই হয়তো আমার কাছে খুব একটা মনে দাগকাটার মতো ব্যাপার হতো না যদি বাবা আজ থাকতেন।সকলের জীবনেই কি বাবা মায়ের ব্যাপারটার সঙ্গে প্রচলিত বাংলা প্রবাদ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না বোঝার মতো হয়ে থাকে?
বাবা যখন মারা গেল তখনো আমার এই টোটো জীবন শুরু হয় নি।টোটো নামক এই কিম্ভূতকিমাচার না রিক্সা , না ভ্যান নামক চার চাকার যান টি তখন ভূমিষ্ঠ ই হয় নি।অতএব বুঝতেই পারছেন, বেশ কয়েক বছর হলো আমি পিতৃহারা।আসলে বাবার মারা যাওয়ার দুঃখ থেকেও বাবার পেনশন না আর পাওয়া যাবে না- এই ব্যথাটাই বাবার ডেড বডির সামনে দাঁড়িয়ে আমার প্রথম মনে হয়েছিল।
আমি মাঝে মাঝে নিজের মনেই ভাবি- কে বেশি মেন্টাল পেসেন্ট? মা? নাকি সুজাতা?
মা ও যেমন আমাদের ছোটবেলায় এমনটা ছিল না, রিঙ্কি বড়ো হওয়ার আগে পর্যন্ত সুজাতাও তো এমন ছিল না।কখনো এটা ভাবতে পেরেছিলাম, দুটো বাড়ি ডিঙিয়ে বাড়ি সঞ্জয় সিংয়ের।সঞ্জয় একদিন আমাকে ডেকে বললো;
আচ্ছা কাবলুদা, কুছু মনে লিবেন না।বৌদি র কি কুছু প্রোবলেম আছে? আমি ছাদ থিকে দেখি যে রক্ ম উনি গোর দিয়ে লাথ মারে আপন লেড়কি কে, ও তো সত্ মা ভি ওই রোকম পিটায় না।
কোনো উত্তর দিতে পারি নি আমি।উত্তর ই বা কি দেবো? রিঙ্কির পড়াশুনো নিয়ে সুজাতা যা করে – আমার কিছু বলার নেই।মেয়েকে ওর এখন ই সেরার সেরা করে তুলতে হবে।
সামনের বস্তির রাজুরমা একদিন বলেই ফেললো;
কাবলু, আগে তুমাদের বাড়ি থিকে একটা আওয়াজ নিকালতো না।তোমার বাবার গলার আওয়াজ কিমন ছিলো- আমরা জানতাম ই না।খালি তুমার দিদি সারমুনিয়া বাজিয়ে গান করতো , আর তুমি তাবলা বাজাতে।ব্যাস্, আর কৌনো শোব্দ তুমাদের মকান থিকে নিকালতো না।
রাজুর মা কি বলতে চাইছে – বুঝতে অসুবিধা হওয়ার মতো তো আর মাথামোটা আমি নই।তবু বোঝাতে পারি নি সুজাতাকে।আসলে টায়ার কোম্পানী বন্ধ হয়ে আমার চাকরি চলে যাওয়া, বাবা মারা গিয়ে বাবার পেনশন বন্ধ, মায়ের হাফ ফ্যামিলি পেনশন– এতো কিছুর ভিতরে তো আমি সুজাতা বা রিঙ্কির জন্যে কখনো কোনোরকম কিপটেমো করি নি।এমন কি দু দুবার ছোড়দির থেকে লুকিয়ে টাকা নিয়েও ক্লাস সিক্সে পড়া রিঙ্কি যে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছি। সুজাতার শখ মেটাতে ওদের সবাই কে নিয়ে সিকিম ঘুরতে গেছি।
যখন নোতুন কিছু আনতে পারি – সুজাতা যেন সেই বিয়ের আগে সাজু হয়ে যায়।এমন টা তো সুজাতা ছিল না।বিয়ের পরে ও তো সুজাতার মেটারিয়ালিস্টিক ডিম্যান্ড তেমন কিছু ছিল না।মেয়ে হওয়ার পর মেয়েকে বড়ো করা নিয়ে স্বপ্ন তো আমরা দুজনে একসঙ্গেই দেখতাম।তাহলে?
এই তাহলে টার জবাব আমি কখনোই খুঁজে পেলাম না।বাবার মারা যাওয়া কি সুজাতাকে ফিনানসিয়াল ইনসিকিওরিটিতে ফেলে দিল? কেন বাড়িতে বৌ থাকতেও মায়ের দুবেলা খাবার আমাকে পাড়ার হোম সার্ভিস থেকে নিতে হয়- এই প্রশ্ন যখন আশেপাশের লোকেদের চোখে দেখি- এড়িয়ে যাই।
তা বলে এই কঠিন বাস্তবের সামনে তো আর ছোড়দির সামনে এড়িয়ে যেতে পারি না।বাবার নার্সিংহোমের খরচ সব ছোড়দি করেছিল।কিন্তু সুজাতার কথায় আমি তা নিয়েও ছোড়দির উপর চোটপাট কম করি নি।
মাঝে মাঝে ভাবি, ছোড়দি তার বাবার জন্যে সাধ্য মতো করেছিল, যেমনটা ও করে থাকে আমাদের সকলের ই জন্যে।তবু ছোড়দিকে বৌয়ের কথায় কেন দু টো কটু কথা বলেছিলাম? আমার যুক্তি, বিচার বোধ সেদিন কেন কাজ করে নি? ভারোবাসা, স্ত্রী , সন্তানকে ভালোবাসা- তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করা– এসব ই তো যুক্তিবোধ বাদ দিয়ে হতে পারে না।বৌকে ভালোবাসব, সন্তানকে ভালবাসব- আর সেই ভালোবাসার জন্যে মা, বাবা , আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে অহেতুক দূরত্ব তেরি করব- এটা তো আদৌ কোনো যুক্তিবোধের দ্বারা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।তবু যা হতে পারে না, সেই হতে না পারাটাই কেন করেছিলাম? পড়াশুনো শেখার ভিতর দিয়ে যে মনের শিক্ষা , রুচি, বিবেকবোধ, যুক্তিবোধ, সবরকমের দায়িত্বপালনে একটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়– তা কি আমার হয় নি?
এতো বড়ো বাড়িটাতে মা এখন একা থাকে।আমি সারাদিন টোটো চালাই।শিক্ষিত বেকার হয়ে বেঁচে থাকার থাকার গ্লানি ভুলতে টোটো কিনেছি বাবার জমানো টাকা দিয়েই।একের পর এক ব্যবসা করতে গিয়ে বাবার জমানো টাকা জলে ফেলেছি চাকরি যাওয়ার পর।এখন টোটোওয়ালাদের সঙ্গে স্টান্ডে দাঁড়িয়ে ওদের মতো কথায় কথায় খিস্তি দিয়ে কথা বলতে পারি না বলে প্রায় সব টোটো ড্রাইভার ই আমাকে বেশ ব্যাঁকা চোখে দেখে।
মাঝে মাঝে রাতে মার কাছে থেকে যাই বলে ও সুজাতার কাছে কথা শুনতে হয়।তবু টোটো টা নিয়ে যখন ম্যাসেনজার তুলে ছুটি তখন বাইরের দমকা হাওয়া গায়ে লাগলে , এই এতো কিছুর পরেও কিন্তু বেশ ভালোই লাগে।তখন ই কিন্তু মনে পড়ে যায় সুজাতার সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটার কথা।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।