কলমের খোঁচা

সতীনাথদা,বেগুনভাজা আর মাধবটোরি – গৌতম রায়।


চিন্তন নিউজ:৭ই জুন:-কিশোরটির বড়ো ইচ্ছে গান শিখবেন। থাকেন চুঁচড়া কাঁকশালী ,পোষাকী নাম কনকশালীতে।মহসীন কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই নাড়া বেঁধেছেন ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের কাছে। মার্গ সঙ্গীতের কিংবন্তী ওঙ্কারনাথ ঠাকুর নন।তবে ধ্রুপদী গানে সেই ওঙ্কারনাথেরও দখল কম ছিল না। তিনি প্রথম একটা বছর ধরে ছাত্রটিকে কেবল সা থেকে কোমল সা শিখিয়ে গেলেন। সরগমের অন্য কিছুটিই নয়। সা য়ের উচ্চারণ নিয়ে সেই থেকেই তিনি একটু খুতখুতে ও ছিলেন।মানুষটির নাম সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।

আটের দশকের গোড়াতে মহাজাতি সদনে একটা জলসা হবে। তখনও এধরণেরর অনুষ্ঠানকে প্রোগ্রাম বা ফ্যাংশনই বলা হতো।’শো’ বলবার রেওয়াজ চালু হয়নি । ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।মহাজাতি সদনে। আয়োজকরা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন,” দরদীয়া” আর “মরমীয়া” বলে।এতো অব্যর্থ বিশেষণে দু’জনের সম্বন্ধে বুঝি বা আর হয় না। শব্দদুটি যেন ধনঞ্জয়বাবু আর সতীনাথদার জীবনে ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছিল।

সতীনাথদাকে মেশোমশাই বলতাম প্রথম প্রথম। উৎপলা সেনের প্রবল আপত্তিতে উনি হয়ে গেলেন আমার সতীনাথদা। প্রথম যেদিন তাঁর কাছে গান্ডা বাধলাম আবদার মেনে প্রথম দিনই শেখালাম, “জাগিছে ধীরে প্রভাত রবি,করবী চাপায় ছোয়া যে লাগে, কে গো ছড়ালে আলোক ছবি”র মুখরাটা। ভাঁয়রোতে সতীনাথদারই সুর, ওঁরই গাওয়া। প্রথম দিনই বোঝালেন “ভৈরবী” আর “ভাঁয়রো” র ফারাক। একটি ক্লাস সেভেনের ছাত্রকে তার উপযোগী করে রাগরাগিনীর গভীর তত্ত্ব কি যে প্রাঞ্জল করে বুঝিয়েছিলেন । তেমনটি তাঁর ছাত্রটির প্রায় বুড়ো বেলাতে করে কম্মে খাওয়ার একমাত্র উপায় ” ইতিহাস” তার ছাত্রদের পড়ানোর সময়েও পারে না।

গলার ভয়েস থ্রোয়িং শুনেই স্কেল ঠিক করে দেওয়ার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল ওঁর।প্রথমবার ওঁর বাড়ি গেছি পিসতুতো দাদার সঙ্গে।লাইট ক্লাসিক বা আধুনিক গান শিখি -এটা বাবা একদম পছন্দ করতেন না।রবীন্দ্র সঙ্গীতের পাশাপাশি তাঁর পছন্দ ছিল ক্লাসিকাল। ভর্তিটিও করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সতীর্থ শিবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের কাছে। বাবার শঙ্কুদা, বামুনগাছির শিবশঙ্কর মুখুজ্জে ছিলেন বাবারই আর এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব নাকুবাবু,সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর শিষ্য।

একটু বিষয়ান্তর হ’লেও পিতৃবন্ধু শঙ্কুবাবুর কাছে শোনা একটা কালোয়াতি গানের বৈঠকি গপ্পো এ প্রসঙ্গে বলবার লোভ সামলাতে পারলুম না।শঙ্কুবাবুর আদি শাকিন বেলেঘাটাতে।সেখানকার বিখ্যাত নস্কর পরিবার খুবই সঙ্গীত অনুরাগী। দেশ বরেণ্য শিল্পীরা মাইফিল জমান নস্কর বাড়িতে।শঙ্কুবাবুর ও সেখানে অবাধ যাতায়াত।মাঝে মাঝেই নস্কর বাড়িতে আসেন আগ্রা ঘরাণার ভারতবিখ্যাত শিল্পী ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব।কখনো কখনো তাঁর শিষ্য কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও থাকেন। এক আধ বার ছিলেন ফৈয়াজ খাঁ র আর এক বিখ্যাত শিষ্যা দিপালী তালুকদার,পরবর্তীকালে না।

  ফৈয়াজ খাঁ সাহেব (কেবলমাত্র খাঁ সাহেব একজনই। ওস্তাদ আমীর খাঁ। তাই বার বার ফৈয়াজ খাঁ, নাম উল্লেখ করে ই লিখছি)একবার আসর জমিয়ে গাইছেন নস্কর বাড়িতে।প্রায় বাড়ির মানুষ শঙ্কুবাবু কোনো একটি বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে এসেছেন।নস্কর বাড়ির অতি প্রাচীন বৃদ্ধ দেহাতি পরিচারক , যাঁর কিনা কোলে পিঠে মানুষ হয়েছেন হেমবাবু,হেমচন্দ্র নস্কর,বিধান রায়ের মৎস মন্ত্রী, সেই বৃদ্ধটি জানতে চাইলেন শঙ্কুবাবুর কাছে।

   ” এ কেয়া হোতারণ?”
শঙ্কুবাবুর স্মার্ট উত্তর ;”ইয়ে তো হিন্দুস্থান কে সবসে বড়া কলাকার হায়।” বিস্মিত সেই দেহাতি বৃদ্ধের উত্তর,”সব সে বড়া কলাকার? আরে হামারা দেশপর ভৈসাভি ইসিতরফ ছিল্লিয়াওতরণ!”
  
একবার সতীনাথদাকে এই গল্পটা বলবার পর উনি “অতল জলের আহ্বান” এর গান রেকর্ডিং এর সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের করুণ দশা এমনই রসিয়ে বলেছিলেন।সতীনাথদারা তখন থাকতেন কেয়াতলাতে। উৎপলা সেনের একান্ত নিজস্ব উচ্চারণে “ক্যায়াতলা”। গানের সময়ে তাঁর উট্চারণের কোনো ত্রুটি কেউ দেখাতে পারবেন না।কথা বলবার সময়ে ওঁর ভিতরে যেন ঢাকার মেয়ে “বেলুন” মাঝে মাঝেই উঁকি ঝুঁকি দিতো।কোনো কাছের মানুষ ই উৎপলা সেনের হাতের নিদেন পক্ষে ” এক প্যায়লা চা” চা না খেয়ে তাঁর বাড়ি থেকে যান নি।

কেয়াতলায় সতীনাথদাদের বাড়িতে হঠাৎ একদিন ভর দুপুরে হেমন্তদা এসে হাজির। কি রে বেলুন? কি রেঁধেছিস? কী একটা মেয়ে রেকর্ডিং এ এসেছে। ক্ষণা ক্ষণা গলা। বিরক্ত হয়ে চলে এলাম–বললেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
 সেই ক্ষণা গলার মেয়েটিই সুজাতা চক্রবর্তী।আর তাঁর যে গানের রেকর্ডিং এর সময়ে  হেমন্তদা রেগেমেগে চলে এসেছিলেন সতীনাথদার বাড়িতে, সেই গানটি হলো,”ভুল সব ই ভুল। এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল।”ওই একটি গানেই অমর হয়ে আছেন সুজাতা চক্রবর্তী। পরে বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন। ফ্যাংশনে সেই সব গান গাইতে বসলেই শ্রোতারা চিৎকার করতেন ,”ভুল সবই ভুল” এর জন্যে। তাঁর গলায় আর কোনো গান শুনতে রাজি ছিল না শ্রোতারা। সুজাতা চক্রবর্তী যেন তাঁর গানের মতোই ,”চলে গেলে থাকবে না তো আর কিছুই  ,স্মৃতি আমার রইবে না তো আর কিছু” ই হয়ে গিয়েছেন।যেমন স্মৃতির অতলে প্রায় হারিয়েই গিয়েছেন সেই গানের ফিল্মে যিনি লিপ দিয়েছিলেন, সেই অসামান্য শিল্পী তন্দ্রা বর্মণ।

উচ্চারণ নিয়ে সতীনাথদা খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন।”স” আর “শ” র উচ্চারণ ভুল  হলেই বকুনি।”বাঙাল নাকি ‘স’ আর ‘শ’ আলাদা ভাবে উচ্চারণ করতে পারিস না।”পাঠক ভেবে নেবেন যে, সতীনাথদা বাঙাল বিদ্বেষী ছিলেন।তাঁর ঘরণী উৎপলা,সতীনাথদার “রোশনী”ই যে ছিলেন খাঁটি ঢাকাইয়া বাঙাল।এই “রোশনী” নামটা ছিল সতীনাথদার ই দেওয়া।আর উৎপলা তাঁকে ডাকতেন ” মানা”। স্বামী মাধবানন্দগিরি ছিলেন ওঁদের গুরুদেব।কোন্নগরে তাঁর আশ্রম।সতীনাথদারা বলতেন”সাধুবাবা”।উনি নাকি বারদির ব্রক্ষচারীর শৈশবের বন্ধু ” বেণীমাধব”।তেমনটাই ছিল সতীনাথদাদের বিশ্বাস।কোন্নগরে তাঁর আশ্রমে গিয়ে তাঁকে দেখবার সৌভাগ্য হলেও সতীনাথদার মুখে সাধুবাবার উবাচ; ইংরেজকে আসতে দেখেছি,যেতে দেখেছি -শুনে হেসে কুটোপাটি হতাম।কেবল ই মনে পড়ে যেত সত্যজিৎ রায়ের “কাপুরুষ মহাপুরুষ” এ চারুপ্রকাশ ঘোষের ডায়লগ।

সতীনাথদা প্রচন্ড রেগে যেতেন। একবার সাধুবাবার আশ্রমে দুপুরে প্রসাদ পেতে বসেছি।ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দময়ী মায়ের পার্থিব লীলা সম্বরণের পর মাঝে মাঝে কোন্নগরে সাধুবাবার আশ্রমে থাকতেন।ছবিমাসীর সুধাকন্ঠের কীর্তনে সাধুবাবার আশ্রমে সন্ধ্যেবেলায় সত্যিই একটা অপূর্ব পরিবেশ রচিত হতো।সেদিন আশ্রমে প্রসাদ বিতরণে তদারকি করছেন ছবিমাসী।জগন্ময় মিত্র ও ছিলেন সাধুবাবার আশ্রিত। তিনিও আমাদের সঙ্গে পঙ্গতে বসেছেন প্রসাদ পেতে।সতীনাথদা বললেন আমায়,   জানিস তো  আগে বেগুণ খেতে দারুণ ভালোবাসতাম। তো খাও না বেগুনভাজা। আজ তো বেগুণ ভাজা হয়েছে-বললেন ছবিমাসী। না ছবিদি, সাধুবাবার আদেশে বেগুনভাজা খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি। আত্মসংযমের জন্যে সাধুবাবার আদেশ–সতীনাথদার জবাব। জগমোহনজী খেতে খেতেই ছড়া বানিয়ে দিলেন, আগে খেতে বেগুন, ভালোবাসতেন দ্বিগুণ।সবাই হেসে উঠলেন হো হো করে।

প্রসঙ্গান্তর হলেও বেগুনভাজা প্রীতি নিয়ে আর এক বিশিষ্ট বাঙালির কথা বলবার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না।ঘটনাটি শোনা আমার “দেশহিতৈষী” র সম্পাদক অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। অশোকদা তাঁর বিয়েতে দলীয় সতীর্থদের সঙ্গেই নিমন্ত্রণ করেছেন জ্যোতি বসুকে। সদ্য প্রাক্তন উপ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু যে সত্যি সত্যিই আসবেন- অশোকদা ভভাবতে পারেন নি।সবাইকে অবাক করে দিয়ে জ্যোতিবাবু এসেছেন অশোকদার বিয়েতে।সকলেই একটু বেশি মনোযোগ দিতে চাইছে জ্যোতিবাবুর প্রতি।তিনি কিন্তু নির্বিকার।কোনো হেলদোল নেই।সকলের সঙ্গেই সেযুগের আঙ্গিকে লাম্বা বেঞ্চি তার উপরে রোল কাগজ বেছানো-জ্যোতিবাবু খেতে বসেছেন।পাতে বেগুনভাজা পড়েছে।তৃপ্তি করে খেয়ে আবার নিজৃর থেকে চেয়ে নিলেন জ্যোতিবাবু বেগুনভাজা।

সাধুবাবার শরীর যাওয়ার পর টোরি রাগ কে ভেঙে সতীনাথদা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর গুরু প্রণামী “মাধবটোরী”।কী অপূর্ব সৃষ্টি।পন্ডিত রবিশঙ্কর পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ওই রাগটি শুনে।মাধবটোরি তে পরবর্তী কালে সতীনাথদা বেশ কিছু রাগাশ্রয়ী গান গেয়েছিলেন।সতীনাথদার অননুকরণীয় উচ্চারণে দ্রুত সরগম, যিনি সামনা সামনি না শুনেছেন,তিনি কল্পনাও করতে পারবেন না, কী স্বর্গীয় আমেজ ছিল তার।

গানে স্বর্গীয় আমেজ তৈরী করার একটা সহজাত প্রবণতা সতীনাথদার ছিল জন্মগত।তাঁর কাছে শোনা একটি ঘটনা।রাজভবনে তখন গানের আসর বসতো মাঝে মাঝে।হরেন মুখার্জী তখন রাজ্যপাল।সতীনাথদা গাইলেন,”কোথা তুমি ঘনশ্যাম।” উপস্থিত ছিলেন বড়ে আলি খান সাহেব।তিনি উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন সতীনাথদাকে।বললেন,” তুম কেওয়ল সতীনাথ নেহি হু,তুম শিবনাথ হু”।
              


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।