রাজ্য

সন্দেশখালি বেঁচে থাকবে অন‍্যায়, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ন‍্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে।


উত্তম দে,চিন্তন নিউজ:২৩/০২/২০২৪:- জমি হাঙরের কবলে পরে, খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক,প্রান্তিক মানুষেরা যে তাদের জমি,বাড়ি খোয়াচ্ছেন তা পুর্বেই সামনে এসেছিল,কিন্তু সন্দেশখালি, জেলিয়াখালি, ধূপখালির প্রতিরোধের পর জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।সন্দেশখালি দু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, কিভাবে জমি জবরদখল করে, জমিতে নোনাজল ঢুকিয়ে বিঘার পর বিঘা জমি,শাসক দলের নেতারা ভেড়ি বানিয়ে তীব্র গতিতে তাদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি করেছে।

এ বাংলা জমিদারী প্রথা, সামন্তপ্রভুদের অত‍্যাচার দেখেছে। ব্রিটিশ আমলেও দেখেছে আবার স্বাধীন দেশেও দেখেছে। ভাঙাচোরা মুখ, ঘামে ভেজা শরীরের মানুষগুলোর কায়িক পরিশ্রমে জমিদারেরা নিজেদের গোলায় শষ‍্যপূর্ণ করে, অত‍্যাচার,শোষন চালিয়েছেন।মানুষও একজোট হয়েছে। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে খাদ‍্য আন্দোলন,তেভাগা আন্দোলন হয়েছে। লাঙল যার,জমি তার দাবী তুলে বুক পেতে গুলি খেয়ে শহীদের ম‍ৃত‍্যূ বরণ করেছিল,কমিউনিস্ট পতাকাতলে সামিল হওয়া, অকুতভয় এই সব প্রান্তিক বীরেরাই।

১৯৭৭ সালে এ রাজ‍্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরই,মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসু,মহাকরণে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, রাইটার্স থেকে সরকার চলবে না। গ্রামে,গ্রামে মহাকরণ গড়ে তোলা হবে।হয়েছিলও তাই। ১৯৭৮ সালে, রাজ‍্যে প্রতিষ্ঠিত হলো দেশের প্রথম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব‍্যবস্থা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ‍্যমে, গ্রামে,গ্রামে গঠিত হল “গ্রাম সরকার”। ঘামে শরীর ভেজা মানুষগুলো, সামান‍্য মাইলো চাইলে, যাদের জুটত কষাঘাত,তারাই নির্বাচিত হয়ে গ্রামোন্নয়নের সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলো। প্রান্তিক মানুষ পেলো মুক্তির স্বাদ। দেশ বিদেশ থেকে প্রতিনিধি দল ছুটে এসে এই নব‍্য গ্রামীন বাংলার উন্নয়ণ যজ্ঞ চাক্ষুস করল।

আজ পরিবর্তনের পরে,সেই ব‍্যবস্থা যে ধ্বংসের মুখে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যাদের আর্থিক ও সামাজিক মানোন্নয়নের স্বার্থে এই ব‍্যবস্থা বামফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত করেছিল,তারা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত।আবাসের অধিকার আজ কোথায়? ঘটনাচক্রে, পাকা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও শাসক দলের নেতা ও তাদের পরিজন, সে সুবিধা ভোগ করছে।নন্দকুমারের আরজুনা বিবির কথা আজো স্মৃতির মনিকোঠায় জ্বলজ্বল করে। সামান‍্য অবাস চাওয়ার দোষে জুটেছিল প্রকাশ‍্যে বেত্রাঘাত, লকআপে বুটের লাথি। সেই গ্রাম সরকার আজ কোথায়? বামফ্রন্ট সরকারের প্রবর্ত্তিত পঞ্চায়েত ব‍্যবস্থার উদ্দেশ‍্যগুলিকে গলা টিপে মেরে, জমিদারী প্রথার আদলেই নব‍্য শোষন প্রথা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আর এই শোষন অব‍্যাহত রাখার কারণেই গণতান্ত্রিক পরিবেশকে কলুষিত করে,নির্বাচনী সন্ত্রাস ও বিরোধীদের দখল করা পঞ্চায়েতকেও জবরদখলের রাজনীতি আমদানী করা হয়েছে, যা বাম আমলে অমিল।

কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউ পি এ সরকারকে অভিন্ন নুন‍্যতম কর্মসুচী ( common minimum program) র ভিত্তিতে বামফ্রন্ট বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। যার অন‍্যতম শর্ত ছিল, নুন‍্যতম ১০০ দিনের কাজের গ‍্যারান্টি আইন। এই প্রকল্প চালু হবার ফলে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গ‍্রামীণ ভারতে এক বিরাট পরিবর্তন হয়। বৃদ্ধি পায় ক্রয় ক্ষমতা। আর আজ সেই প্রকল্পের উপভোক্তাদের জবকার্ড শাসক নেতাদের কুক্ষিগত হবার কথা,সরাসরি উপভোক্তারাই অভিযোগ করছেন। ফলে,বঞ্চিত হচ্ছেন উপভোক্তারা আর লাভবান হচ্ছে শাসক নেতারা। আবার,দুর্নিতীর অভিযোগ এনে,কেন্দ্র রাজ‍্যের প্রাপ‍্য দিতে গরিমসি করলেও, দুর্নীতির প্রশ্নে কোন এজাহার দায়ের করল না। আর রাজ‍্যও,মানুষের করের পয়সায়, সঠিক হিসাব না দেওয়ার, চারটি জেলার পেনাল্টি চুপিসারে প্রদান করে দিলেও, কারোর বিরুদ্ধে কোন ব‍্যবস্থা গ্রহণ না করে, “বঞ্চনা”র রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে ব‍্যস্ত। কেন্দ্র ও রাজ‍্যের এই বালখিল‍্যে গ্রামীণ বাংলা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যে অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বামেদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

বামফ্রন্ট ১৯৭৭ এ ক্ষমতায় এসে, বর্গা আইনের মাধ‍্যমে যেমন প্রান্তিক কৃষককে বর্গার অধিকার দিয়েছিল,ঠিক তেমনিভাবেই,আমুল ভূমি – সংস্কারের মধ‍্য দিয়ে, ভূমিহীনদের জমির অধিকার দিয়েছিল। আজ শেখ শাহজাহানদের মতো জমি মাফিয়াদের কবলে পরে,জমির অধিকার পাওয়া মানুষগুলো নতুন করে ফের ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে যে প্রকল্পগুলি রূপায়ণ করেছিল অথবা কেন্দ্রের ইউ পি এ সরকারকে চাপ সৃষ্টি করে যে ১০০ দিনের কাজের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করাতে পেরেছিল,লুটেরাদের কবলে পরে আজ তা ধ্বংসপ্রাপ্ত।

যে কোন নির্বাচিত সরকারের মুল দায়িত্ব, এমন জনকল‍্যানকর প্রকল্প রূপায়ণ করা,যাতে করে মানবসম্পদ উন্নয়ণ ঘটে। ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকারের মুখ‍্য দিশা সে দিকেই থাকার ফলে,মানুষ যেমন গ্রামসভার মধ‍্য দিয়ে,নিজেদের উন্নয়ণের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারতেন ( পরিবর্তনের পর গ্রামসভা বন্ধ করে দেওয়া হয় ), অন‍্যদিকে, এক ফসলী জমি বহুফসলী হবার ফলে,আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে ধান,মৎস চাষে শীর্ষস্থান অর্জন করে রাজ‍্য। খাদ‍্য ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার পরেও উৎবৃত্ত ফসল রপ্তানী করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি, বর্গা আইন, ভূমিসংস্কারের ফলে সামাজিক মানোন্নয় ঘটে।যা সারা দেশের কাছে একটি দৃষ্টান্ত।
আর সেই কারণেই, সন্দেশখালিতে সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাতেরা গেলে, অশ্রুসজলে গ্রামের মহিলারা বলেন, বামফ্রন্টের দেওয়া জমি ওরা কেড়ে নিয়েছে। মানুষ তার অভিজ্ঞতা, তার উপলব্ধি দিয়েই পুর্বের শান্তির দিন ফিরিয়ে দেবার আকুল আবেদন করছেন অন ক‍্যামেরা।

সন্দেশখালি,একটি উপমা মাত্র। একই চেহেরা রাজ‍্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দু-চার টাকার মাসোহারায় যে, জীবন,জীবিকার সম‍স‍্যা নিরসন হয় না, সেটাও তারা উপলব্ধি করতে পারছেন। আজ যে কথা সন্দেশখালি বলছে, কাল সারা বাংলা বলবে। আজ ভয়কে দুরে সরিয়ে সন্দেশখালি যেভাবে মুখ খুলছে, কাল সারা বাংলা খুলবে। তবু সন্দেশখালি বেঁচে থাকবে অন‍্যায়, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ন‍্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।