কিংশুক ভট্টাচারিয়া:চিন্তন নিউজ:৫ই এপ্রিল:- এইধরনের অস্বাভাবিক, অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে আগে কখনও পড়তে হয়নি। প্লেগ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরবর্তীতে এই প্রথম এই ধরনের এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্য দিয়ে পেরোতে হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনভিজ্ঞতা কখনো হটকারী, বাড়াবাড়ি বা ভুল সিদ্ধান্ত নেবার দিকে নিয়ে যেতেই পারে। সরকারকে বিরোধীপক্ষ সহ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই ভয়ঙ্কর অবস্থার থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে।
সরকার গুলো সবার কাছে মৌখিক সহযোগিতা র আহ্বান করলেও তার বাস্তব উদ্যোগ নজরে আসছে না। যে বিষয়টি দৃষ্টিকটু ভাবে সামনে আসছে তা কিন্তু অনভিজ্ঞতাজনিত ভুল নয়, বরঞ্চ সচেতনভাবে জনগণকে ভুল বুঝিয়ে, এই সময়েও তারা যে ক্রণি ক্যাপিটালিজমের প্রতিনিধি, তাদের প্রতি বিশ্বস্ততা রক্ষায়, স্বার্থ রক্ষায় যত্নশীল। একইসাথে নিজেদের ব্যর্থতা ঢেকে আত্মপ্রচারে ব্যাস্ত। এই দেশেরই একটা দক্ষিণ প্রান্তের আর একটি পূর্বপ্রান্তের রাজ্যকে পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে।
দক্ষিণ প্রান্তের কেরল জনসংখ্যা প্রায় ৩.৫কোটি। জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮৬০জন মাত্র। সেই রাজ্যের সরকার এই ভয়াবহতার মোকাবিলায় হু’র নির্দেশিকা কঠোরভাবে মেনেও সমস্ত গণসংগঠন, সরকারি নীচুস্তর পর্যন্ত পরিকাঠামো সমস্ত এনজিওকে সঙ্গে নিয়ে ঝাপিয়ে পরেছে। ২০হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছেন।
একদিকে সচেতনতা প্রচারে ঐ সংগঠনগুলিকে কাজে লাগিয়েছে, এমনকি ত্রাণ সরবরাহ ও পৌছানর জন্য ঐ সব সংগঠনের নিজস্ব স্বেচ্ছা সাংগঠনিক শক্তি ব্যাবহার করছেন। ঐ বাবদ খরচ বাঁচিয়ে তা চিকিৎসা বা ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহে ব্যাবহারে লাগাচ্ছে। রোগ নির্মুল করতে কমিউনিটি টেষ্টের ব্যবস্থা করে প্রতি ৫/৬হাজার পিছু ১জনের(যদিও এই সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়) টেষ্টের ব্যাবস্থা করেছে। যাতে প্রথমেই আক্রান্তকে খুঁজে বের করে সংক্রমণের বিস্তার রোধ করা যায়। লকডাউন কে শুধু প্রচারের মধ্যে দিয়ে সফল করার বদলে বাস্তবিক সাফল্যর স্বার্থে বাড়ি বাড়ি রেশন পৌছান,২০টাকা থালির খাবার ব্যবস্থা বাড়ান, লকডাউনে আটকে পরা পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকা, খাওয়া সহ চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সহ অর্থ বরাদ্দ করেছেন। এসবের কার্যকরী করার জন্য ওখানে সরকার তার নিম্নস্থ পঞ্চায়েত, পৌরসভা, বিভিন্ন গণসংগঠন ও এনজিও গুলিকে কাজে লাগিয়ে ছেন।
এরজন্য তাদের মুখ্যমন্ত্রীর মুখের ছবি দেওয়া, দিশাহীনের মতো মুখ্যমন্ত্রীকে রাস্তাঘাটে ছুটে বেড়াতে হয়নি। দক্ষিণে র রেওয়াজ মতো মূখ্যমন্ত্রীর কাট আউটেরও প্রয়োজন পরে নি। যতোটা সম্ভব দায়িত্ব সবার মধ্যে ভাগ করে ও খরচের সামর্থ্যানুযায়ী সিংহভাগ সরকার নিজের কাঁধে নিয়ে সমস্যার মোকাবিলা করছেন।এখন চায় দিশাহারা,আত্মপ্রচার সর্বস্বতা নয়, মানুষকে বাঁচানোর নির্দিষ্ট পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
এই সময় হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা আলোচিত হতে পারে কিন্তু ইতিপূর্বে এই বিষয়গুলি আলোচিত তাই থাক। ঐ সরকারের প্রধান শুধু কিছু গিমিক ছড়া কোন ভূমিকা ই পালন করছেই না। হয় থালা বজান নচেৎ মোমবাতি জ্বালান আর বীমা কম্পানিগুলি অনাদায়ি ঘাটতি মেটানোর পরিকল্পনা করাই তার কাজ। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলের অস্তিত্ব থাকতেও পিএম কেয়ার নামক নতূন তহবিল সৃষ্টি করে সবাই কে তহবিলে দান করতে উৎসাহিত বা ভুল বুঝিয়ে দানে বাধ্য করা হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
এবার বরঞ্চ আসা যাক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এখানের মুখ্যমন্ত্রী সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করছেন বলে দিনরাত প্রচার মাধ্যমে প্রচারীত। সত্যিটা কি? প্রায়৯.৫ কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট একটি রাজ্য যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০২৮জন বসবাস করে সেই রাজ্যে এই বিপদ মোকাবিলায় সরকার যে তহবিল তৈরী করেছেন তার মূল্যমান মাত্র ২০০কোটি।জনসংখ্যা ও সমস্যার ব্যাপকতার তুলনায় এই অর্থ অতি সামান্য। আজ আবার নতূন ব্যাখ্যা সহ ঐ তহবিলকে মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে যুক্ত করে ঐ তহবিল বাস্তবায়নের বদলে ত্রাণ তহবিল থেকেই কাজ সারার চেষ্টা মাত্র। এই সমস্যা নিয়ন্ত্রনে মূল উদ্দেশ্যে খরচের কোন পরিকল্পনার ছাপ কিন্তু দেখি যাচ্ছে না। খাদ্য সামগ্রী যা বিলি হচ্ছে তা এখনো প্রতিশ্রুত পরিমাণের অনেক কম। তাওতো সাধারন ব্যবস্থা থেকেই হচ্ছে। এর জন্য কোন তহবিলের প্রয়োজন ছিলো না। অর্থের প্রয়োজন ছিলো এই মহামারীর সময় যাঁরা মুখোমুখি লড়াই করছেন সেই চিকিৎসা কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী ও পৌরসভাগুলির পরিচ্ছন্নতা যাঁরা বজায় রাখেন তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা তাঁদের কাজের সুযোগ ও স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি করা। সমগ্র পরিকাঠামোগুলোর যথোপযুক্ত ব্যাবহারের জন্য প্রয়োজনীয় যোগানের ব্যাবস্থা, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল নামে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা নির্মানগুলিকে করোনা চিকিৎসা বা কোয়ারান্টাইন আবাস হিসেবে উন্নিত করার পরিকল্পনা ও বরাদ্দ। এক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে প্যান্ডেল করে করোনা হাসপাতাল তৈরীরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার বদলে বাস্তব চিত্র কি দেখছি, রেনকোট দিয়ে পিপিইর প্রতিস্থাপনের চেষ্টা। মাস্ক স্যানিটাইজার, গ্লাভসের সরবরাহ নাম মাত্র।
প্রতি ৫হাজার জনসংখ্যা পিছু ১জন এএনএম ২জন সেকেন্ড এএনএম, এবং ৩/৪ জন আশাদিদি নিয়ে ১টা সাব সেন্টার থাকার বদলে আছে ১০হাজার জন পিছু। তাও তাঁরা হাতে পান ২০০মিলি স্যানিটাইজার, ২টি মাস্ক পিপিই,বা গ্লাভস নেই। সঙ্গে আছেন অঙ্গন ওয়ারি কর্মী ও সহায়িকারা। এরা তো কিছুই পান না। অথচ প্রাথমিক রিপোর্টের জন্য প্রতি বাড়িতে নিয়মিত যাতয়াতের ফলে এরা সংযোগে যেতে বাধ্য। বিশেষত যখন বাড়ির কোনও সদস্যকে দিয়ে খাতায় সই করাতে হচ্ছে তখন কি এঁরা সংক্রমণের সহজ মাধ্যম হচ্ছেনাকি?
আর যথাযথ নিরাপত্তা ছাড়া এই অসম সাহসিক লড়াইয়ের সৈন্যবাহিনী যদি সেনাধ্যক্ষের ঔদাসীন্য র স্বীকার হয়ে মনোবল হাড়িয়ে ফেলে তাহলে কি এই লড়াই শুরুর আগেই আমরা হারতে শুরু করবো না?
একটা কথা আসবে বীমা। সেখানেও প্রশ্নের অবকাশ আছে। এখন এই সরকারের সিদ্ধান্ত অসুস্থ হলেই করোনা বলা যাবে না। অর্থাৎ সংক্রমণের প্রকাশ হবার পর তাঁর পরীক্ষা করে রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তিনি করোনা আক্রান্ত নন। এবং রিপোর্ট কনফার্মেশনের আগে মৃত হলে বীমাকৃত তাঁর পরিবার পেতে পারেন না।
অথচ অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে যেটা নজরে পরছে তা যেন ভারতবর্ষেরমধ্যে একমাত্র একজনই এই লড়াই একাই লড়ছেন এটা প্রতিষ্ঠার এক উদগ্র প্রচেষ্টা। এই মুহুর্তে বাংলার ২১টি চ্যানেলেই সারাদিনে প্রতি ব্রেকে ৩.৫মিনিটের প্রচার। কতো কোটি টাকা প্রয়োজন হচ্ছে? লাগাতার লকডাউন জনিত ফাঁকা রাস্তায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সহ ফ্লেক্স বেঁধে প্রচার কি খুবই প্রয়োজন ছিলো? তা বদলে যে ক্লাবগুলিকে এতো দিন বছর বছর লক্ষ টাকা দিয়েছেন এই সময় তাদের ডেকে নির্দিষ্ট নিয়মে প্রচারের দায়িত্ব দিলে সেটা কি বেশী ভালো হতো না?
বিভিন্ন সময়ে জনবহুল এলাকাতে পাত্র মিত্র সমভ্যবিহারে সরজমিন তাঁর উপস্থিতি একদিকে সমস্যার জন্ম দিচ্ছে আর নিরাপত্তা ও যাতায়াত খাতে খরচ হচ্ছে প্রচুর ওদিকে কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীরা পরিবহন বাবদ ১৫০০টাকা পাবার সরকারি নির্দেশ সত্বেও পাচ্ছেন না। রাস্তায় নেমে দিশাহীন দৌড়াদৌড়ি তে ,গোলা আঁকার মধ্য দিয়ে উনি তো এটাই প্রমাণ করছেন যে কেউ নেই উনি ছাড়া আর গোটা যন্ত্রটাই অকেজো। এতে কি কাজটা, লড়াই টা আরও একটু বেশী জটিল হচ্ছে না? বর্ডার সিল করা মৃত্যু ও সংক্রমণ কমিয়ে দেখিয়ে উনি হয়তো আপাত বাহবা পাচ্ছেন। কিন্তু এতে মানুষের মধ্যে একটা সিউডো ট্রুথে বিশ্বাস প্রবণতা জন্মানর সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। আর এটা হলে ওঁর এতো প্রচেষ্টা নিজেকে তুলে ধরার সেটাকি আরও বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে না? এর ফলে যদি সংক্রমণ আউটবার্ষ্ট করে তখনতো দাঁড়ানো র জায়গাও থাকবে না। বরঞ্চ যে সামান্য ২০০কোটির থহবিল আছে তাই দিয়ে সামনের সারি লড়াকু চিকিৎসাকর্মী বা গ্রামীন স্বাস্থ্যকরমীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ইক্যুপমেন্ট দেবার ব্যাস্থা করাটা বেশী জরুরি। আমি তো সাংবাদিক বৈঠকে উনি যখন।বলেছিলেন যে তাঁর পিপিই,মাস্ক গ্লাভস, স্যানিটাইজার ইত্যাদি বিলির ক্ষেত্রে প্রায়োরিটি ওঁরা যাঁরা বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে সেবা ও পরিষেবা দিচ্ছেন। তখন স্যালূট করতে ইচ্ছে করছিলো। একজন যথার্থ নেতৃত্ব মনে হয়েছিলো তখন। কিন্তু বাস্তব তো অন্য ঈঙ্গিত করছে শুধুই আত্ম প্রচার অন্য সবই লেস প্রায়োরিটি।
।