শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

নিরাপদ মাতৃত্ব


প্রতিবেদন ডাঃ স্বপ্না চট্টরাজ চিন্তন নিউজ: ২৮শে মে:– আজ ২৮ শে মে বিশ্ব মাতৃত্ব দিবস। সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য দিবস হিসাবে এই দিনটি পালিত হতো। ১৯৮৭ সাল থেকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসাবে পালন করা শুরু হয়েছে। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হয়। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে সকল নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরন করাই হলো নিরাপদ মাতৃত্ব।

প্রায় ১৪০০ জন রোজ মারা যান গর্ভাবস্থা ও প্রসবজনিত সমস্যায়। শিশু মৃত্যুর হার ও আমাদের দেশে উর্দ্ধমুখী । ৩০% উপরে শিশু জন্মগ্রহণ করে কম ওজন নিয়ে। বাকী ৭০% শিশুর ওজন উন্নত দেশগুলির শিশুর ওজনের তূলনায় অপেক্ষকৃত কম। একটি কম ওজনের শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যেমন কম তেমনই বর্তমানে বেঁচে গেলেও ভবিষ্যতে সেই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তার জন্মকালীন কম ওজন। তাছাড়া মধ্যবয়সে এসে হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস মেলাইটাস , ইত্যাদি রোগ এমনকি বুদ্ধির বিকাশে ঘাটতি দেখা যায় । তাই নিরাপদ মাতৃত্বের উপর আমাদের অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। নিরাপদ মাতৃত্ব সম্পর্কে জানা ও তা মেনে চলাটাই আজকের দিনে খুব জরুরী।
একজন গর্ভবতী মহিলাকে সাধারণত তিনটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
১) গর্ভাবস্থা
২)প্রসব
৩) সন্তান জন্ম নেওয়ার পরবর্তী পর্যায়
গর্ভবতী হয়েছে এটা জানার পর প্রথম কাজ হলো কোনো চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বা চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়া । এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যা হল যেহেতু গর্ভাবস্থায় , প্রসবকালে বা সন্তান জন্ম হবার পর বিপজ্জনক সমস্যা দেখা দিতে পারে তাই সব পরিবারের উচিৎ নিকটবর্তী হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রের অবস্হান জেনে রাখা ।সম্ভব হলে হবু মা’র অস্থায়ী ভাবে চিকিৎসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাওয়া উচিৎ যাতে চিকিৎসা পেতে দেরি না হয়। সব প্রসব বিশেষতঃ প্রথমবার হাসপাতাল বা প্রসূতি সদনে বেশি নিরাপদ।

নিরাপদ মাতৃত্ব একটি জীবনের অধিকার । এই গর্ভাবস্থায় ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে জন্মপূর্ব যত্ন (Antenetal care ) এটা খুবই জরুরী। এটির দুটো দিক আছে ১) চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা করবেন ২) চিকিৎসক গর্ভবতী মহিলাকে কিছু পরামর্শ দেবেন, যা পরবর্তীকালে নিরাপদ মাতৃত্ব হতে সহায়তা করবে এবং সুস্থ সন্তান হতে ও সাহায্য করবে। এই সময়ে চিকিৎসককে সব ধরনের সহযোগিতা গর্ভবতী মহিলাকে করতে হবে। সাধারণ ভাবে চিকিৎসক প্রথম চেক-আপ (check up) গর্ভাবস্থার ১২ সপ্তাহের মধ্যে করে থাকেন। এই চেক-আপ (check up) এর মধ্যে চিকিৎসক গর্ভবতী মহিলার যাবতীয় তথ্য রেকর্ড করে রাখেন। সেখানে যেমন মহিলার নাম, ঠিকানা,বয়স আগের কতগুলো সন্তান আছে জানা হয় তার সাথে মহিলার সোশ্যাল দিকটিও রেকর্ড করে রাখা হয় । যেমন মহিলার বিবাহের তারিখ , উনি সিঙ্গল বা বিধবা কিনা ইত্যাদি। তার সাথে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার পেশা, তার পারিবারিক আয় , বাড়িতে প্রাপ্তবয়স্ক ক’জন , বাচ্চা ক’জন, তার সোসিও-ইকোনমিক ক্লাস (socioeconomic class ),তার বাসস্থান ও জাতি ইত্যাদি । এছাড়াও মেনস্ট্রুয়াল হিসটোরি (menstrual history) যেটা খুবই জরুরী একটা দিক। এছাড়া গর্ভবতী মহিলার জেনারেল ফিজিক্যাল একজামিনেশন (general physical examination) করা হয়। দ্বিতীয় চেক-আপ (check up) করা হয় ২৮ সপ্তাহের মধ্যে । চার সপ্তাহ অন্তর একবার। এই সময়ডে অফ কুইকেনিং (“date of quickening ” ) মানে বাচ্চা মায়ের শরীরের ভিতরে নড়ছে এই অনুভূতি মা পায় সেটা রেকর্ড করা হয়ে থাকে। এই সময় মা ‘র ওজন নেওয়া হয়। রক্তাপ্লতা আছে কিনা, রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা, পা ফুলছে কিনা তাও দেখা হয় । এবং যথাযথ ব্যাবস্হা নেওয়া হয়।
তৃতীয় চেক-আপ(check up) ২৮ সপ্তাহের পর করা হয়। ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সপ্তাহে দুবার এবং তারপর সপ্তাহে ১ বার বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত। এবার আসি চিকিৎসকের পরামর্শে।

সাধারণত চিকিৎসক গর্ভবতী মহিলার গর্ভাবস্থায় কি ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাবে তা বলে দেবেন। গর্ভাবস্থায় যখন মা এবং তার মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তানের স্বাস্থ্য অনেকাংশে নির্ভর করে মায়ের খাদ্য গ্ৰহনের ওপর , শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যা যা পুষ্টি দরকার তার সবটাই আসে মায়ের গর্ভাবস্থায় গ্রহন করা খাদ্য থেকে। গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের স্বাভাবিক অবস্হার তুলনায় অনেক বেশি পুষ্টির প্রয়োজন । এই অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে পুষ্টির চাহিদা পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথম তিন মাসে বেশি পরিমাণ প্রোটিন, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি১২ এবং জিঙ্কের প্রয়োজন হয়। মাঝের ও বিশেষ করে শেষের তিন মাসের শিশুর সর্বাধিক দৈহিক বিকাশ হয়। তাই এই সময়ে প্রোটিন (১৫ গ্ৰাম অতিরিক্ত), লৌহ (অতিরিক্ত ৮ মি.গ্ৰা )ক্যালসিয়াম (অতিরিক্ত ৬০০ মিঃ.গ্রা ) ফসফরাস ( অতিরিক্ত ১০০০মি.গ্রা ) বি গ্রুপের ভিটামিন প্রয়োজন হয়। এ সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করতে হবে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে , বৃক্ক ও মূত্রাশয়ের সংক্রমণ নিবারণ করতে সহায়তা করবে। অ্যালকোহল , ধূমপান, পান ও পানমশলা এই সময়ে এড়িয়ে চলতে হবে। । চা কফি না খাওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই সময়ে কোনোরকম উপবাস করা চলবেনা।

গর্ভাবস্থায় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে থাকা খুবই জরুরী। প্রত্যেকদিন স্নান করা, জামা কাপড় কাঁচা পরিস্কার পরতে হবে।ঢিলেঢালা পোশাক পরা বাঞ্ছনীয়। পরিমিত বিশ্রাম, ঘুম গর্ভাবস্থায় শেষ দিন পর্যন্ত নিয়মমাফিক করতে হবে। রাত্রে ৮ ঘন্টা ও দুপুরে ২ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন হয়। হালকা ব্যায়াম , হালকা গৃহস্থালির কাজ, খোলা হাওয়ায় একটু হাঁটা চলা শেষ দু’মাস করা উচিৎ । চাকুরীরতা মহিলারডেলিভারি ডেট (delivery date) এর কমপক্ষে ৬ সপ্তাহ আগে ছুটি নিয়ে ঘরে বসে থাকা দরকার। (Immunization) ইমিউনিজেশন গর্ভাবস্থায় জরুরী একটা বিষয়। খিঁচুনি রোধ করার জন্য ২০ তম সপ্তাহে টিটেনাস টক্সোয়েড (Tetanus toxoid) নেওয়া খুবই জরুরী। দ্বিতীয় ডোজ প্রথম ডোজের ৬ সপ্তাহ পরে এবং তৃতীয় ডোজ- দ্বিতীয় ডোজ এর ৬ মাস পরে নিতে হবে। নিরাপদ মাতৃত্ব পেতে হলে এসবের সাথে গর্ভবতী মহিলাকে মানিয়ে চলতে হবে।

শিক্ষিত সুস্থ মেয়েরা যারা ছোটবেলায় ও কৈশোরে ভালো পুষ্টিকর খাবার পায় তাদের গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালে কম সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শে থেকেও অনেক সময় কিছু বিপত্তি হতে পারে। তখন সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া দরকার। কিছু বিপদ সংকেত উল্লেখ করছি , ১) গর্ভকালে যোনিদ্বার থেকে রক্তপাত বা প্রসবের পর খুব বেশি রক্তপাত।২) খুব বেশি মাথা ব্যাথা বা পেটব্যথা। ৩) খুব বেশি জ্বর আসা । ৪) হিসেব অনুযায়ী সময়ের আগেই জল ভেঙে যাওয়া ৪) শরীরে খিঁচুনি হওয়া।
অনেক সময় গর্ভবতী মহিলারা শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হয়। তাতে মা ও ভ্রুণের ক্ষতি হয়। পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয় না। সরকারী চাকুরীজীবীদের জন্য ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলেও বেসরকারী পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে এখনো ছুটি থেকে বঞ্চিত। ছুটি অনেক সময় দিলেও বেতন দেওয়া হয়না। মায়ের সুস্থতার উপর নির্ভর করে সন্তানের নিরাপদ জন্ম ও সুস্থ জীবন। তাই নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার আদায়ে সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম সহ সমাজ সচেতন সকল নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। গত বছরের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের উদযাপনের থিম ছিল “করোনা ভাইরাস চলাকালীন বাড়ীতে থাকুন, মা এবং নবজাতককে করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদে রাখুন।” এ বছর নিরাপদ মাতৃত্ব ও সংক্রমন থেকে সুরক্ষার প্রচার করা হচ্ছে।

করোনা সময়কালে গর্ভধারণ কতটা নিরাপদ এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মা দের বলা হয়েছে যাতে এ সময়ে সন্তান না আসে । কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি লকডাউনে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভবতী বেড়ে গেছে। তাই জন্মপূর্ব যত্ন (Antenatal care) এর জন্য যেখানে ভীড় কম সেখানে যাবার কথা বলা হয়েছে।সামাজিক দূরত্ব (Social distance) করতে হবে। এ সময় কোনো বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, শপিং মল ইত্যাদি জায়গায় যাওয়া যাবেনা। গর্ভবতী অবস্থায় কোভীড ভ্যাকসীন নেওয়া যাবেনা। বেশি বেশি করে সুষম খাবার খেতে হবে। যদি করোনা পজিটিভ হয় তাহলে অবশ্যই যে চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বাড়িতে ডেলিভারি করা যাবেনা। নিরাপদ প্রসূতি সদনে যেতে হবে। প্রসব পরবর্তী সময়ে মা আক্রান্ত হলেও বাচ্চা মায়ের দুধ পান করতে পারবে। তবে মা কে মাস্ক পরতে হবে। ভারতে করোনা কালে চারটি জন্মপূর্ব যত্ন (Antenatal care) পাচ্ছেন মহিলারা । যা ৫১% কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সংখ্যা ৭৯% কমেছে। কোভিড মহামারীতে মাতৃ মৃত্যুর হার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সঙ্কট আমাদের দেখিয়েছে প্রয়োজনীয় পরিসেবা জরুরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরোও শক্তিশালী হওয়া দরকার। শুধুমাত্র একটি দিবসে আটকে না থেকে মাতৃস্বাস্থ্য, নিরাপদ প্রসব , পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার গুনগত মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গর্ভবতী মহিলার মানসিক পরিচর্যার উপরেও জোর দিতে হবে। এবং সামাজিক কুসংস্কার থেকে গর্ভবতী মহিলাকে মুক্ত করতে হবে। তবেই আমরা নিরাপদ মাতৃত্বের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।