কলমের খোঁচা

এস ওয়াজেদ আলি: জীবন্ত ডায়নামিক শিল্পী-গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ: ১০ই জুন:– বাংলার সামাজিক প্রেক্ষিতে যখন এস ওয়াজেদ আলী নিজেকে ধীরে ধীরে কথা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছেন , সেই সময়ে গোটা দেশ তথা বাংলা  একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়া জনিত বিপন্নতা য় ক্লিন্ন, অপরদিকে এক ধরনের মূল্যবোধের সংকট জনিত বিপন্নতা ।বিশ শতকের সেই বিপন্নতা বাঙালি সমাজে সাম্প্রতিক অতীতে  ক্ষয়িষ্ণুতার কড়াল ছায়াকে যেন প্রথম প্রকটিত করে তুলছিল।

                 জীবন দর্শনের   ক্ষেত্রে  সমাজ, ধর্ম এবং সত্তার বিচ্ছিন্নতায় চারিদিকে এক ধরনের নতুন বিপন্নতা বোধে তখন ক্লিষ্ট। ব্যক্তি অস্তিত্বের সংকট গ্রাম-শহরের ভিদ রেখাকে প্রায় অ প্রকট করে তুলছে ।চারিদিকে যেন কেমন একটা অনাস্থার পরিবেশ ক্রমশ প্রবল হচ্ছে।

                       ১৮৯০  সালের ৪ ঠা  সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহাকুমার অন্তর্গত জনাইয়ের  কাছাকাছি বড়তাজপুর গ্রামে এস ওয়াজেদ আলী যখন  জন্মগ্রহণ  করেন ,তখন বাংলার সামাজিক পরিবেশ এক ক্রান্তিকালে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হুগলি চন্ডীতলা নবাবপুরে ওয়াজেদ আলীর মাতামহের বসবাস ছিল। 

                   এই গ্রামটি ওয়াজেদ আলীর অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ,আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা চেতনার বিকাশে একটা বড় অবদান রেখে গেছে। তিনি নিজেই সেই গ্রামের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন ;” দক্ষিণ দিকে কতটা পথ গিয়ে নদী বাঁক ফিরেছিল। বাঁকের মুখে নদীটা খুব চওড়া। একদিকে নৌকার ঘাট। সেখানে অনেকগুলি নৌকা বাঁধা থাকত। আর অপরদিকে ছিল প্রকাণ্ড একটা বটগাছ ।এক পাল রাজহাঁস তলায় তার খেলা করতো।

                   নদী বাঁক ফিরে পূর্বদিকের গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। নানা দের বাগান থেকে একটা বাঁশের সাঁকো নদী অতিক্রম করেছিল ।তাই দিয়েই লোক এপার ওপার যাওয়া-আসা করত ।

                 নানাদের পারে নদীর পাড়ে একটা বাঁশবন ছিল ।আমি সেই বাঁশবনে দাঁড়িয়ে অনেক সময় নদীর উপর দিয়ে নৌকার যাওয়া-আসা দেখতুম আর কতো কি  ভাবতুম( এস ওয়াজেদ আলী রচনাবলী,১ম খন্ড, পৃ- ৫৭০)।”

                শৈশবের এই চেতনার জগত  সমালোচকদের ভাষায় এস ওয়াজেদ আলী কে জীবন্ত ডায়নামিক শ্রেণীর মানুষের পরিণত করেছিল। সেই সময়ের পারিপার্শ্বিকতার আদর্শ বিচ্যুতি এবং তার ঘূর্ণিপাকে রাজনীতির আবর্তন –ওয়াজেদ আলী চেতনার জগতকে প্রথম থেকেই প্রভাবিত করেছিল ।তাই তিনি কখনো সীমাবদ্ধ লক্ষ্যচিহ্ন ছিন্ন শিল্প সাধনাতে, সাহিত্যকর্ম তে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। তৃপ্ত হতে পারেননি ।

                  এই সমাজভাবনাই  ওয়াজেদ আলী সৃষ্টিকে এক গতিশীল জীবনের প্রতীকে পরিণত করেছিল। তাঁর গোটা জীবনের সাধনা কে তিনি প্রবাহিত করেছিলেন সমাজ সভ্যতার ধারাবাহিকতার বেষ্টনীর  ভিতরে এক গভীর উচ্চ বোধসম্পন্ন  চৈতন্যাভিমুখী মানুষের জীবন সাধনা তে।

                    খুব স্পষ্ট ভাষা দিয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন;  আর্ট ফর আর্টস শেক  কথাটা ঠিক নয় ,কেননা, আর্টের কারবার ভাবকে নিয়ে ,আর ভাবের মূল্য নির্ভর করে তার বিষয়বস্তুর উপর। আমাদের বলা উচিত আর্ট ফর হিউম্যানিটি শেক।

                  অর্থাৎ ;মানুষ শিল্পের জন্য নয়, শিল্প হচ্ছে মানুষের জন্য ।কোন সাহিত্য প্রশংসনীয় আর কোন সাহিত্য প্রশংসনীয় নয় তার বিচার করবার আগে আমাদের স্থির করতে হবে ,কোন জিনিসটা কাম্য ,আর কোন জিনিসটা কাম্য নয় মানুষের জন্য( সাহিত্য জীবনের শিল্প )।

                   ওয়াজেদ আলীর জীবন ও সৃষ্টির কালটি এক ভয়াবহ ধর্মীয় সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হানাহানি, দ্বিজাতিতত্ত্বের অন্ধ বিতংসের প্রলোভনের চোরা গলিতে রাজনীতিকদের নানা ধরনের অপপ্রয়াস এবং অপপ্রচারের যেন এক যুগসন্ধিক্ষণে অবস্থিত ছিল।

                   এই কঠিন আবর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওয়াজেদ আলী যেভাবে তাঁর নিরপেক্ষ ইতিহাসবোধ ,বিবেচনাবোধ এবং ভবিষ্যতের প্রতি সঠিক বিশ্লেষণী, মননশীল ভাবনা দিয়ে গেছেন তা আজ গভীর ভাবে চর্চা করলে আমাদের বিস্ময় জাগায় ।

                   তিনি লিখছেন ; সাহিত্যিক জাতির রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং স্বার্থ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করতে পারে না ।সেইজন্য সাহিত্যিক হিসেবে আমি এইটুকু বলতে চাই যে ,স্বাধীন বঙ্গের আদর্শ সম্মুখে দেখেই ভবিষ্যতে আমাদের সাহিত্য সাধনার পথে অগ্রসর হতে হবে।

            ‘ সাহিত্য জীবনের শিল্প’  এই প্রবন্ধে তিনি খুব দ্বর্থ্যহীন ভাষায় বলছেন; ” আমার মনে হয় ,ভারতীয় জাতীয়তাকে প্রাদেশিক জাতীয়তার ভিত্তির উপরই গড়তে হবে। প্রত্যেক প্রদেশের ভাষাকে অবলম্বন করে সেই প্রদেশের হিন্দু এবং মুসলমান কে একতার সুনিবিড় সূত্রে গ্রথিত করতে হবে। প্রত্যেক প্রদেশের হিন্দু মুসলমান যথাসময়ে তাহলে একটি জাতিতে পরিণত হবে। আর সেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক মিলনে গড়ে উঠবে ভবিষ্যৎ ভারতের রাষ্ট্রসংঘ, ফেডারেশন অফ স্টেটস ।

               তবে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশের ভৌগোলিক সীমার নির্দেশ বাঞ্ছনীয় এবং স্বাভাবিক।”  যে কোনো ধরনের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই ছিল এস ওয়াজেদ আলীর সব সৃষ্টির মূল সুর ।ধর্ম থেকে দেশপ্রেম -যেকোনো ধরণের রক্ষণশীলতা কে তিনি তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করে গেছেন ।গোটা জীবনের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন ;

                 গোঁড়া ধার্মিক প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক নয় ,সে হল ধর্মের নামে একটা বিকৃত প্রতিচ্ছবি ,ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যারিকেচার। সেইরকম গোঁড়া  ভারতবাসী কিংবা গোঁড়া বাঙালি -ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক নয় ;সে হল দেশপ্রেমিকের বিকৃত প্রতিকৃতি-।

               তাই আমরা তাঁর কলম থেকে ঝরে পড়তে দেখি ; আমি মুসলমান সমাজের বটে, কিন্তু তার উপর আমি মানুষ। আমি ভারতবাসী বটে, কিন্তু তার উপর আমি মানুষ। আমি বাঙালি বটে কিন্তু তার উপর আমি মানুষ (সাহিত্য জীবনের শিল্প )।

                 তাঁর বহুলপঠিত “ভারতবর্ষ” গল্পটি  যেন ভারতীয় জীবনের একটি অক্ষয় চৈতন্যকে আবিষ্কার করবার চেষ্টা। সতত প্রবাহমান মানুষের জীবনের বিশ্বাস ,সেই বিশ্বাসের বিবর্তন এবং তাকে অবলম্বনের  ভেতর দিয়ে যে একটা চিরন্তন সত্য প্রকাশের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টা –এটাই ওয়াজেদ আলী ওই গল্পটির ভেতর দিয়ে  গোটা মানব সমাজ কে যেন বলতে চেয়ে ছিলেন।

                      ১৯৫১   সালের ১০ই জুন বেশ কয়েক বছরের রোগভোগের পর তাঁর জীবনাবসান হয় কলকাতার ৪৮, ঝাউতলা রোডের বাসভবনে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।