কলমের খোঁচা

পিট সিগার-এর ভালোবাসার গান — কঙ্কণ ভট্টাচার্য


চিন্তন নিউজ:৩রা মে:– বিভিন্ন সত্ত্বার সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয়ে একজন পূর্ণ মানুষ গড়ে ওঠে। এইরকম একজন পূর্ণ মানুষ পিতামাতাকে সম্মান করবেন, ছোটদের স্নেহ করবেন, বন্ধুদের প্রতি সহমর্মী হবেন, নিজের প্রিয় বান্ধবী বা স্ত্রীকে ভালোবাসবেন, বন্ধুর সাফল্যে আনন্দিত হবেন,অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হবেন, মানুষের অধিকারের সংগ্রামে সামিল হবেন এবং এ সবকিছুর মধ্য দিয়েই জীবনের পথচলাকে উপভোগ করতে করতে অনুভব করবেন জীবনই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কাগজে কলমে এই অবধি ঠিকই আছে।

কিন্তু বাস্তবে আমরা অনেক সময়েই জীবনের বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে পারিনা। এরফলে জীবন হয়ে পড়ে একপেশে। যেমন হয়ত একজন শ্রমিক নিজেকে একজন শ্রমিক ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। হয়তো তার মধ্যে একটা শিল্পী সত্ত্বার আছে কিন্তু তিনি সেটা নিজেই মনে রাখেন না। অথচ তিনি যদি তার শ্রমিক জীবনের সঙ্গে শিল্পীসত্ত্বার সমন্বয় ঘটাতে পারেন তবে তার কারখানার হাতুড়ি বা মেসিন চালনাতেও শিল্পের ছাপ পড়বে। একজন সংগ্রামী যিনি নিত্যদিন মানুষের জন্য সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তার জীবনেও তো প্রেম ও ভালোবাসার একটা জায়গা আছে। তিনি যদি এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন না করতে পারেন তবে তার জীবন কখনো সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনা, কারন তার জীবনের এক দিকে থাকবে সংগ্রাম আর একদিকে থাকবে প্রেম ভালোবাসা, তিনি কখনোই দুটোকে একসঙ্গে ভাবতে পারবেন না। একই ভাবে একজন গণশিল্পীর মধ্যেও যদি বিভিন্ন সত্ত্বার মিলন না ঘটে তবে তার সৃষ্টিও সাধারণ মানুষের জীবনের অন্দরমহল কে ছুঁতে পারবে না।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও কিছু আগে কলকাতায় প্রথম বারের জন্য গাইতে এসেছিলেন আমেরিকার একজন সদ্য চল্লিশোর্ধ শিল্পী যিনি পৃথিবীময় মানুষের মুক্তি, অধিকার আর স্বাধীনতার গান গেয়ে চলেছেন। কলকাতা জানলো তার নাম পিট সিগার। সারা পৃথিবী তখন যুবকদের আন্দোলনে উত্তাল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ক্রমে ভয়ংকর চেহারা নিচ্ছে। হাজার হাজার যুবককে জোরকরে যুদ্ধে পাঠানোর বিরুদ্ধে আমেরিকার যুবরা জোর প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলছে। তার পাশে দেশবাসীর বড় অংশ। ভারতে কলকাতায় জোরদার ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন।

আমেরিকায় যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শিল্পীমুখ পিট সিগার গাইতে উঠে প্রথমেই বললেন, আমি মনে করি দুনিয়ার সব গানই আসলে ভালোবাসার গান। ভালোবাসা না থাকলে একজন শিল্পী স্রষ্টা কি করে মানুষকে বা তার নিজের দেশকে ভালোবাসবেন। আসলে ভালোবাসাই মূল আর জীবনের যত কিছু ভালো সব কিছুই তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে’। তাই একজন শিল্পীকে প্রথমে প্রেমিক হতে হবে, যে প্রেম নিজের নিকট জন থেকে যাত্রা শুরু করে বিশ্ব প্রেমে পৌছবে। এমন কথা একজন প্রতিবাদী শিল্পীর মুখে শোনা যাবে এটা হয়তো অনেকেই আশা করেন নি। কিন্তু তার এই একটি মূল্যবান কথা আর তার গান মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। কারন তিনি যা বিশ্বাস করেন তারইতো প্রতিফলন তার প্রতিটি গানে। এভাবেই তিনি সারা পৃথিবীর যুব মনের প্রাণের শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার গান সেই কথাই বলবে।

১৮৭১ সালে শ্রমিক শ্রেণী প্রথমবারের মত ক্ষমতা দখল করেছিলেন প্যারিসের মাটিতে। তারা গঠন করেছিলেন প্যারী কমিউন। ৭২ দিন পরে প্রতিবিপ্লবীদের আক্রমণে কমিউন ভেঙ্গে পড়ে। পলাতক বিপ্লবীরা আশ্রয় নেন জঙ্গলে। সেখানেই বিপ্লবী কবি ইউজেন প্যতিয়ের রচনা করেন ‘আন্তর্জাতিক সঙ্গীত’, যা পৃথিবীর প্রথম গণসঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃত। এরপর সংগ্রামী গণসঙ্গীতের এক ধারা গড়ে উঠলো, যার চূড়ান্ত বিকাশ দেখা গেল রুশ বিপ্লবী সংগ্রামে। ভারতে তথা বাংলায় গণসঙ্গীত সৃষ্টি আরম্ভ হয় ১৯২৬ সালে যখন কাজী নজরুল আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের অনুসরণে রচনা করেন অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত। ১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের জন্মের সংগে সংগে গণসঙ্গীতের সৃষ্টির ধারা নতুন বেগ পায়। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়,সলিল চৌধুরী,হেমাঙ্গ বিশ্বাস সহ বহু স্রষ্টার অবদানে তৈরি হতে থাকে বহু গণসঙ্গীত। তাদের সৃষ্ট বহু গানের সঙ্গে আমরা পরিচিত।
আমেরিকাতেও ১৯৪১ সালে পিট সিগার ও তার বন্ধুরা যখন ‘আ্যলমানাক’ নামে গানের দল গড়ে ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রামের জন্য গান গাইতে আরম্ভ করলেন তখনও তাদের গানে পরিচিত গণসঙ্গীতের ধারাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ১৯৫৩ সালের পর যখন পিট দল ছাড়া একাই গান গাইতে আরম্ভ করলেন তখন তার গানেও এল এক অভুতপূর্ব পরিবর্তন। গণসঙ্গীতকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ময়দান থেকে বিস্তার ঘটিয়ে তিনি এনে ফেললেন মানুষের একেবারে দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের মাঝে। তৈরী হতে লাগলো এক অন্য জাতের গণসঙ্গীত যার বিস্তার অনেক বেশী। যাকে সংগ্রামের গানের পাশাপাশি ভালোবাসার গান বলতে একটুও আটকায় না। দু একটা উদাহরণ দিলেই তা পরিষ্কার হবে। যেমন ধরা যাক এই গানটি: যদি থাকতো আমার সোনালি সূতো আর সূঁচ সরুমাথা, বুনতাম আমি রামধনু রঙে এক সে নক্সী কাঁথা, এক সে যাদুর কাঁথা।
আমি বুনতাম তাতে জন্মদাত্রী মায়েদের বীরগাথা
আর আঁকতাম যত সরল শিশুর সবুজ মনের কথা শিশুর মনের কথা।
সাত সমুদ্র তের নদী পার সেই কাঁথাটাকে নিয়ে
নগর শহর প্রতি জনপদে দেখাতাম বেড়িয়ে
আমি দেখাতাম বেড়িয়ে।
আমি দেখাতাম যত ভাই বোনেদের রঙিন কাঁথার কাজ
প্রাণে মনে আর হাতে হাতে মিলে এক হত তারা আজ
এক হত তারা আজ।
দূর দূরান্তে পৌছে যাবো মানুষের ঠিকানায়
যেন সাড়া পাই অনুভবে আর হৃদয়ের ভালোবাসায়
হৃদয়ের ভালোবাসায়।।

বুঝতে অসুবিধা হবেনা এ গানের ব্যাপ্তি কতদূর হতে পারে। অথচ গানটি রচনা করলেন কখন? ১৯৫০এর দশকের শেষের দিকে পিট কিছু পুরনো কমিউনিষ্ট বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তাদের পুরনো গানের দল, গানের ভাবনা আর স্বপ্নের কথা নিয়ে সারাদিন মত বিনিময়। একটা পুরো দিন বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করে তিনি খুশী মনে বাড়ী ফিরে এলেন। তার পর রচনা করলেন এই গান।
পিট সিগারের আর একটি বিখ্যাত গান ‘রক্ষা করুন ঘাসেদের’। আমরা কেউ কখনো ভেবে দেখেছি কেন গরীবের দরজায় ঘাস জন্মায়। মানুষের জয় এবং সত্যের প্রতি বিশ্বাস কত রকম ভাবে প্রকাশ করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই গানটি। ছোট ছোট ঘাসেদের বেড়ে ওঠাকে পিট কোন দৃষ্টিতে দেখছেন একটু শোনা যাক:
প্রভু রক্ষা করুন ঘাসেদের যারা ফাটলে উঁকি মারে
কংক্রিটে চাপ দিয়ে তারা ক্রমেই ধীরে বাড়ে
কংক্রিট হল ক্লান্ত তার কি আছে করার
ভেঙে পড়ে, শেষে ঘাস বেড়ে ওঠে আকাশে মুখ তার প্রভু রক্ষা করুন ঘাসেদের।
প্রভু রক্ষা করুন সত্যকে যারা সূর্যের দিকে চায়
মিথ্যাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে যারা মুক্তির নেশা ছড়ায়
ভুমিতলে তার শিকড় মেলে আকাশে মুখ তুললো,তার কিছু পরে সর্বখানে সত্যের ঝড় উঠলো, প্রভু রক্ষা করুন সত্যকে।
প্রভু রক্ষা করুন ঘাসেদের যারা সিমেন্ট ফাটিয়ে বাড়ে, তারা সবুজ তারা চনমনে তারা নমনীয় হতে পারে।
কিছুকাল পরে যখন তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়
বেড়েই চলে জীবন্ত ঘাস পাথরের পরাজয়
প্রভু রক্ষা করুন ঘাসেদের।
প্রভু রক্ষা করুন ঘাসেদের ওরা নম্র এবং শান্ত
তবু শিকড় তাদের গভীর তারা বাড়তে হয়না ক্লান্ত আরো রক্ষা করুন সত্যকে যারা গরীবের সহায়
তাইতো বুনো ঘাসেদের বাড়বারন্ত গরীবের দরজায়।
আমাদের সংসারেই এমন কিছু কিছু মা মাসী পিসীদের পাওয়া যায় যারা অতি সামান্য মশলা বা কখনো প্রায় কোন কিছু ব্যবহার না করেই চমৎকার সুস্বাদু খাবার রান্না করতে পারেন। ঠিক সেই রকম শুধুমাত্র পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখার মধ্য দিয়েই পিট সিগার সাধারণ বিষয়কে অসাধারণে পরিণত করতেন। রোজ রাত আসে, আবার রাতের শেষে দিনের আলো ফোটে। এতো সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু রাতের শেষে ভোরের পূর্ব মুহূর্তকে তিনি নতুন চোখে দেখে বললেন জেনো এই সময়েই অন্ধকার সব চেয়ে ঘন, কিন্তু তাই বলে ভয় পেয়োনা, কারন একটু পরেই তো ভোর আসবে। আর এই কথার মধ্য দিয়েই এক অমোঘ বিশ্বাসের বীজ বপন করলেন শ্রোতাদের চেতনায়: ভোরের আগেই জেনো ঘোর আঁধার এই ভাবনাই চলার শক্তি আমার এ কথা বুঝলে ভাঙবে ঘুমের ঘোর
আসলে তো সময় এখন এক নতুন ভোর।
কেউ বলে মানব জাতি আর বেশীদিন নয়
কিভাবে হল তারা এমন নি:সংশয়
আমি জানি যারা শুনছো আমার এ গান
তোমরাই তো গেয়ে উঠবে মুক্তির জয়গান।
তাই হাল ছেড়োনা যতদিন আমরা বাঁচি
হারাবার কিছুই তো নেই সব হারিয়েই আছি
যখন আমার গলায় খেলবে না আর গান
তরুণ বন্ধু কোন তুলবে নতুন তান। তাই, ভোরের আগেই জেনো ঘোর আঁধার এই ভাবনাই চলার শক্তি সবার এই পৃথিবী জুড়ে আনন্দ বেদনা
আমরাই তো গেয়ে চলি আগামীর বন্দনা।
সারা জীবনে অসংখ্য গান গেয়েছেন পিট সিগার। সব গানই মানুষের মুক্তি, অধিকার, সুন্দর জীবন আর এক বৈষম্যমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নের প্রতি নিবেদিত। সরল জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী অহংকারহীন এই মানুষটির প্রতি রাষ্ট্রের আক্রমণ নেমে এসেছে বহুবার। ১৭ বছর তিনি নির্বাসিত ছিলেন বেতার এবং টেলিভিশন থেকে। কিন্তু কেউ তার গান থামাতে পারেন নি। আমেরিকার সাধারণ মানুষ তথা বিশ্ববাসী তাকে আগলে রেখেছিলেন মণিমুক্তার মত। যৌবনের জয়গান গাওয়া মহান শিল্পীর এই গানটি পাঠ করলে সৃষ্টির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং দায়বদ্ধতা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না।

আমার জীবন বয়ে চলে সুরের নদী জলে
পৃথিবীর কান্নাকে ছাপিয়ে আমি যেন শুনি এক দূরাগত ধ্বনি সৃষ্টির জয়গানে মাতিয়ে।
জীবনের যত বাধা আর লড়াইয়ে সেই সুর হৃদয়ে রাখি তা আমার চেতনায় প্রতিধ্বনিতে বাজে কি করে না গান গেয়ে থাকি। ঝড়ের মাতনে যে সঙ্গীত বাজে তার মাঝে সত্যকে জানি
আমার চতুর্দিকে আধার ঢাকা আর তার মাঝে সকাল কে চিনি কোন ঝড় জেনো পারবেনা টলাতে (আজও) পাহাড় চূড়া ছোঁয়া বাকি
ভালোবাসা পৃথিবীর সব সেরা সম্পদ কি করে না গান গেয়ে থাকি।
যখন অত্যাচারী কাঁপে মৃত্যভযে মুক্তির ঘন্টা বাজাতে থাকি যখন বন্ধুরা কাছে দূরে উল্লাসে মাতে কি করে না গান গেয়ে থাকি

গানের সূত্র: (১) মূল গান: Oh Had I a golden thread. (২) মূল গান : God bless the grass. (৩) মূল গান: Quite early morning (৪) মূল গান: How can I keep from singing. সব কটি গানের অনুবাদ লেখককৃত।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।