রত্না দাস: চিন্তন নিউজ:২৭ শে আগস্ট:- সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু বন্দোপাধ্যায় ১৯২০সালের ২৬শে আগস্ট ঢাকা বিক্রমপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।ঠিক ১০০ বছর আগে। তার পিতা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেট এর উচ্চপদে কর্মচারী। মাতা সুনীতি দেবী ছিলেন স্কুল ইনস্পেক্টর।
ঢাকা বিক্রমপুরের সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় তর্কযোগ্যভাবে বাঙালির সর্বকালের কৌতুক অভিনেতা। চিরকাল তিনি আদর্শের জমিতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। গর্ব করে বলতেন, “বাবা আমার নাম রেখেছেন সাম্যময়। আমি একজন সাম্যবাদী । সাম্যের স্বপ্ন আমার নামের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে।’ ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ তিনি কলকাতায় প্রয়াত হন।
ভানু বন্দোপাধ্যায় ছিলেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের আদর্শে অনুপ্রাণিত। তিনি দশ/বারো বছর বয়সেই স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় তার পরিচয় হয় দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে যাকে তিনি দীনেশ দা বলে ডাকতেন। স্কুল ছুটির পর বেলা বারোটায় খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমাতেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সদরঘাটে।সেখানে ছিল লঞ্চ-স্টিমারের নিত্য আনাগোনা। এই দীনেশ দা প্রায়ই ছোট ভানুকে কাজ দিতেন যা তিনি খুব উৎসাহের সাথে পালন করতেন। গোপনে বিপ্লবী বই আনা নেওয়া, টিফিন বাক্সে করে রিভলবার পাচার করা সবই দীনেশ গুপ্তের নির্দেশে তিনি করতেন। ঢাকা সদরঘাটে ঘুরতে আর কোন ব্রিটিশ পুলিশ এল কোথায় গেল তার খোজ রাখতেন তিনি। সেখান মাঝিমাল্লা ও গাড়োয়ানদের সাথে ভাব করে তাদের থেকে তাদের কুট্টি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশদের গতিবিধির সমস্ত খবর জেনে নিয়ে তা দীনেশ গুপ্ত কে দিতেন।দীনেশ গুপ্ত তাকে খুব ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। তিনি ছোট ভানু কে লজেন্স বিস্কুট দিতেন। এমনকি সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতেন ও শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের গান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএ পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ,কবি মোহিতলাল চট্টোপাধ্যায়, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ,কবি জসিম উদ্দিন ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ছিলেন তার শিক্ষক। সকলেই তাকে খুব স্নেহ করতেন। বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে ছিল তার আজীবনের সম্পর্ক। প্রতি জন্মদিনে মাস্টারমশাইয়ের জন্য ফুল মিষ্টি নিয়ে যেতেন তিনি।
দীনেশ গুপ্তের নির্দেশে সব কাজই করতেন তিনি। সেই সূত্রেই তার সাথে আলাপ হয় আরেক বিরাট বিপ্লবী বিনয় বসুর। তার সাথেও ভানুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল। এর কয়েক বছর পরেই বিনয় বাদল দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন ও সিম্পসন সাহেবকে হত্যা করেন। বিনয়-বাদল-দীনেশ হয়ে উঠলেন মৃত্যুঞ্জয়ী। তাদের স্মৃতি সারা জীবন আগলে রেখেছিলেন তিনি। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত ছিল তার আদর্শ। তিনি জীবিত থাকাকালীন প্রতিবছর দীনেশ গুপ্তের আত্ম বলিদান দিবসে একদম সকালে তার শহীদ স্তম্ভের কাছে উপস্থিত থাকতেন।শহীদ স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করে চুপচাপ স্তম্ভের পাশেই বসে থাকতেন। অনেক পরে তিনি লিখেছেন, “ভগবান তোমার লীলা বোঝা ভার। একটা ব্যাপারে তোমার উপর আমার ভীষণ রাগ। তুমি আত্মার নিজস্ব কোন শক্তি দিলে না কেন? দিলে দীনেশের আত্মা এখনকার বাকসর্বস্ব ,অসৎ রাজনীতি ওয়ালাদের মুন্ডু ছিড়ে ফেলতেন”।
বিনয় বসু কর্তৃক ঢাকার মিসফোর্ড হাসপাতালে কুখ্যাত আইজি প্রিজন লোমান হত্যার ঘটনার রোমহর্ষক বিবরণ নিজেই লিখেছেন। সেখানে উল্লেখ করেছেন যে বাঙ্গালী কন্ট্রাকটর পলায়নরত বিনয় বসুকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য হাসপাতালের মাঠে তাকে জাপটে ধরেছিল। বিনয়ের বলিষ্ঠ ঘুষিতে দাঁত অকালে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। হাসপাতালে মেথর সুষেন পাঁচিলের গেট খুলে বিপ্লবী বিনয় বসুকে পালাতে সাহায্য করে ধরা পড়েছিলেন। পরে পুলিশের অকথ্য অত্যাচারেও সে মুখ খোলেননি।সাধারণের চোখে ছোটলোক এই মানুষটির প্রতি ছিল তাঁর অসীম শ্রদ্ধা। দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির পরদিন ভানু দেখেছেন ঢাকার কুখ্যাত গুন্ডা ভোলামিঞার আচরণ। যাকে অসামাজিক কাজের জন্য বেদম পেটাতেন দীনেশ গুপ্ত ও তার ছেলেরা। দীনেশ এর মৃত্যুতে সেই লোকটাই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে কেঁদেছে। পরবর্তীকালে ভানু বলেছিলেন, “বিনয়- বাদল- দীনেশ বিদেশে জন্মালে তাদের কথা পাঠ্যপুস্তকে লেখা হতো। দেশে খাঁটি মানুষ তৈরি হতো সকলের জানতেন কি জাতের দামাল ছেলে সোনার বাংলায় জন্মেছিল।”
দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির পর তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন।সেই সময় এক ব্রিটিশ ইনফর্মার খুন হয়। সেই খুনে তার নাম জড়িয়ে যায় এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোয়়।তখন তিনি তার বন্ধু গোপাল মিয়ার গাড়িতে সিটের নিচে পাটাতনের লুকিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসেন ।তিনি কলকাতায় এসে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করেছিলেন। তারপর তিনি আয়রন এন্ড ষ্টীল কোম্পানিতে চাকরি নেন। এর পাশাপাশি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সাথেও ছিল গভীর যোগাযোগ। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা হচ্ছে আর গ্যালারিতে ভানু নেই এটা কল্পনার বাইরে ছিল।
১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম চন্দ্রগুপ্ত নাটকের অভিনয় করেন। সেই বছরই তিনি বেতার শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় কে বিয়ে করেন। তার পরেই তিনি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান ।প্রথম কয়েক বছর তাঁর সিনেমা জনপ্রিয় হয়নি এরপর ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় সাড়ে চুয়াত্তর ।তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ দর্শক। তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তিনি সবসময়ই বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চল্লিশ দশকের শেষে পূর্ব বাংলা থেকে আসা মানুষদের জন্য মেঘনাথ সাহার নেতৃত্বে ‘ ‘ ইস্ট বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’ গঠিত হলে তিনি দিনরাত এক করে কাজ করেছিলেন। সেই সময় সলিল সেন উদ্বাস্তুদের নিয়ে লেখেন ‘ নতুন ইহুদি’। সেই নাটকে তার অভিনয় দেখে সকলে মুগ্ধ হন। তিনি ৩০০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার অনবদ্য অভিনয় আজও ভুলতে পারেনি দর্শক।
শিল্পী কলাকুশলীদের প্রয়োজনে সব সময় তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন ।তাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য একটানা আন্দোলন করেছেন শিল্পী সংসদের ব্যানারে। পাঁচ বছর তাকে ব্ল্যাক লিস্টে ঢোকানো হয় ।কার্যত তাকে সব প্রযোজকরা একঘরে করে দিয়েছিল। এতেও তিনি না ঘাবড়িয়ে শিরদাঁড়া সোজা রেখেই চলেছেন। তিনি পেট চালানোর জন্য নিজের যাত্রা দল তৈরি করে গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা করেছেন। কিন্তু কিন্তু কারোর কাছে মাথা নত করেননি।
মাস্টারদার সহযোদ্ধা বিপ্লবী অনন্ত সিংহকে তিনি খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। অনন্ত সিংহ তার দুটি ছবির প্রযোজক হয়েছিলেন। প্রথম দুটি ছবি ‘শেষের পরিচয়’ ও ‘ নতুন প্রভাত’ দুটি ছবিই ফ্লপ হয়। পরের ছবিটা অবশ্য ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ ‘। সেই ছবিটি হিট হয়। ভানু সম্পর্কে অনন্ত সিংহ বলেছিলেন, “ছায়া ছবির মাধ্যমে সামাজিক দুষ্কর্ম, সরকারের অক্ষমতা ও তথাকথিত নেতাদের প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে তার পূর্ণ ও বিদ্রূপাত্মক অভিনয় যারা দেখেছেন তারা বলবেন ভানু বাবুর অন্তরে স্বদেশ প্রেমের আগুন প্রজ্জ্বলিত আছে।’
বাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।