কলমের খোঁচা

এঙ্গেলস দু’শো বছরে। – অর্ণব রায়


চিন্তন নিউজ:২৮/১১/২০২০- এঙ্গেলস ছিলেন ঠিক ছ’ফুট লম্বা । দ্রুত গটমট করে চলা আর সৈনিকসুলভ ধরণধারণের জন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে তাঁর ‘জেনারেল” নামকরণের কিছুটা সম্পর্ক ছিল। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের সময় Pall Mall Gazette পত্রিকায় যে অসামান্য প্রবন্ধগুলি লিখেছিলেন তাতে যুদ্ধ-শিল্পের কলাকৌশল সম্পর্কে এতখানি জ্ঞানের পরিচয় মিলেছিল যে পাঠকরা ভেবেছিলেন ওগুলি কোন মস্ত সামরিক বিশেষজ্ঞের লেখা। যুদ্ধটির যে ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেছিলেন তা মিলে গিয়ছিল পরে। অবশ্য লেখক সত্যিই বিশেষজ্ঞ ছিলেন বটে। তবে ওই মস্ত বিশেষজ্ঞটি ছিলেন সমাজতন্ত্রী। অবশ্য পরে , মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক বাহিনীর সর্বময় নেতা হয়ে দাঁড়ান। এঙ্গেলসের বাড়ীতে রবিবারের ব্যাপারটা বোবেলের মিনারের মত হরবোলার আসর হয়ে দাঁড়াত। কারণ সেখানে , হরেক দেশ থেকে আগন্তুক সমাজতন্ত্রীরা ১২২ নম্বর রিজেন্ট পার্ক রোডকে তাদের মক্কা বানিয়ে তুলত। আর , এঙ্গেলস এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের নিজস্ব মাতৃভাষায় আলাপ করতে পারতেন। মার্কসের মত তিনিও জার্মান, ফরাসী , ইংরেজী নিখুঁতভাবে বলতে-লিখতে পারতেন , প্রায় অতটাই নিখুঁতভাবে লিখতে-বলতে পারতেন ইতালি-স্প্যানিস-ডেনিস ভাষা । রাশিয়ান , পোলিশ, রুমানিয়ান , লাতিন,গ্রীক পড়তে পারতেন ও কাজ চালানোর মত লিখতে পারতেন।_এঙ্গেলস ছিলেন মূর্তিমান আতিথ্য ।কিন্ত যাকে তিনি অবিশ্বাস করতেন তাকে আতিথ্য দেওয়া বা আপ্যায়ন করা তাঁর ধাতে ছিল না।”– মার্কস কন্যা এলিওনিয়ারের স্বামী এডওয়ার্ড অ্যাভেলিঙের এই স্মৃতিচারণা থেকে ব্যক্তি-এঙ্গেলসের অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া গেলেও খুবই আংশিক ।

এঙ্গেলস ছিলেন প্রকৃতই বহুগুণসম্পন্ন। ভাল অশ্বারোহী , দক্ষ সাঁতারু , উৎপাদনশিল্প বিশেষজ্ঞ, সুবক্তা, অসাধারণ বিশ্লেষণসঞ্জাত লেখার ক্ষমতা , ক্লান্তিহীন সংগঠক, পরোপকারী – -যেন শেষ নেই। মার্কসের অপর জামাতা পল লাফার্গের কথায় , “বিজ্ঞান ছিল এঙ্গেলসের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় , যদিও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও তাঁর আগ্রহ ছিল প্রচুর। ”

এঙ্গেলসের “প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা” বইটি মানবসভ্যতার সম্পদ যে বইগুলি তাদের অন্যতম । বইটির পাতার পর পাতায় পদার্থবিদ্যা , রসায়ন,গণিত, জীববিদ্যার উদাহরণ পড়তে পড়তে মনে হয় কোন বিজ্ঞানীর লেখা পড়ছি। তাঁর জগদ্বিখ্যাত বই “অ্যান্টি -ডুরিঙ ” , বিজ্ঞান -দর্শন-অর্থনীতি- রাজনীতি- সংস্কৃতি বিষয়ে মনীষার ও বোঝাপড়ার অনন্য পরিচয়। “অ্যান্টি -ডুরিঙ ” বইটির ওপরেই পৃথিবীতে কত যে বই লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । সেন্ট সাইমন- ফুরিয়ার- ওয়েন দের ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্য কোথায়, তা সবচেয়ে প্রাঞ্জল হয়েছিল তাঁর লেখাতেই। বুর্জোয়া শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যের মূল দ্বন্দ্বটিকেই তখন রাজনৈতিকরা ধরতে পারতেন না। শ্রমিক শ্রেণী যে একটি স্বাধীন শক্তি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে তা তারা ভাবতেনও না।‌ মার্কস-এঙ্গেলস বিশ্লেষণ করে দেখালেন , শ্রমিক শ্রেণীই আগামী পৃথিবীর অগ্রদূত। পুঁজিবাদ নিজের মৌলিক সমস্যার কোন সমাধান করতে পারবে না। একটা থেকে আরেকটা সংকটে জড়াবে , সংকটের পুনঃপুনঃ আগমনে ক্ষয়িষ্ণু হবে। সবচেয়ে বেশী ভাষায় এবং সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় অনূদিত-প্রকাশিত বই “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” কেউ কেউ বলেন মূল খসড়া তাঁরই- তবে মার্কস তার ওপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন -সংযোজন ও চূড়ান্ত করেন। তবে, “ম্যানিফেস্টো” মার্কস- এঙ্গেলসের দুজনেরই যৌথ মৌলিক চিন্তা ও সমাজ- ইতিহাসের অনুধাবন দক্ষতার ফসল হিসাবেই স্বীকৃত। যেখানে তাঁরা দুজন প্রথম ব্যাখ্যা করেন যে — এযাবৎ পৃথিবীর লিখিত ইতিহাস হল আসলে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।

“সাম্যবাদের সূত্র ” এঙ্গেলস লিখেছেন -যেখানে খুব সহজভাবে সাম্যবাদী মতাদর্শের মূল কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে প্রশ্নোত্তরে ব্যাখ্যায়িত হয়েছে। দার্শনিক ব্রাউয়ার ভাতৃদ্বয় পার্টি ও রাজনীতির উর্ধ্বে , ব্যবহারিক জীবনের উর্ধ্বে প্রচলিত ব্যবস্হার সমালোচনা করাকেই একমাত্র করণীয় বলে মনে করতেন। মার্কস ও এঙ্গেলস “হোলি ফ্যামিলি” তে দেখালেন যে , সমালোচনা করতে হবে এবং তাকে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিকল্প অভিমুখে নিয়ে মেতে হবে।

লেনিন যাঁকে “প্রলেতারিয়েতের মহান যোদ্ধা ও শিক্ষক” বলেছেন সেই এঙ্গেলসের সঙ্গে মার্কসের বন্ধুত্ব শুধু এক বিপ্লবী , আদর্শগত বন্ধুত্ব ছিল না , তা ছিল অক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বন্ধুত্ব। মার্কস না থাকলে তিনি এঙ্গেলস হতেন না , এটা সত্য । তেমনি ,এটাও অনস্বীকার্য, মার্কসের পারিবারিক শোকদিনে , আর্থিক সঙ্কটে, লেখায় , চিন্তায় , কমিনটার্ন গড়ে তোলা ও অন্যান্য শ্রমজীবী সংগ্রাম গড়ে তোলার সাংগঠনিক কাজে এঙ্গেলস পাশে না থাকলে মার্কসও পূর্ণ বিকশিত হতেন না। বস্তুত , মার্কস ও তিনি কাজ ভাগ করে নিয়েছিলেন । মার্কস মূলত অর্থনীতি নিয়ে বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মার্সকবাদের বিজ্ঞান -দর্শন-সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিষয় গুলি বিকশিত করার কাজে এঙ্গেলসকে বেশী নিয়োজিত হতে হয়েছিল। মার্কসের সঙ্গে এঙ্গেলসের চিঠিপত্রগুলি বিশ্ব শ্রমজীবী আন্দোলনের অন্যতম সম্পদ । মার্কসের মৃত্যুর পর সভ্যতার চিন্তা-সংগ্রামের বিকল্প বৈজ্ঞানিক দিশার সর্বোচ্চ শিখর “ক্যাপিটাল ” বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ডদুটি মার্কসের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে এঙ্গেলস প্রকাশ করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে শ্রমজীবী মানুষদের সাম্যবাদী আন্দোলনে সংগঠিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।‌ সেই সময়ের আমেরিকাতেও যান, পুঁজিবাদের সম্ভাব্য আগামী পীঠস্হানকে দেখতে।‌ এঙ্গেলসকে বন্ধু পেয়ে মার্কসের খুবই গর্ব ছিল -কারুর সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হলেই মার্কস তার কাছে এঙ্গেলসের গুণের তালিকা নিয়ে বসে যেতেন , আবার যেরকম দুরন্তপনার সঙ্গে মধ্যবয়সেও ঘোড়া ছুটিয়ে শিকারে চলে যেতেন এঙ্গেলস ,তাতে এঙ্গেলসের জীবন নিয়ে তাঁর শঙ্কার কথাও প্রকাশ করতেন। এহেন ‘দুরন্ত ‘ এঙ্গেলস কিন্ত তাঁর আইরিশ স্ত্রী লিজা বার্নসের মৃত্যুতে কয়েকদিনের জন্য একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন-তাঁরা নি:সন্তান ছিলেন। অথচ , কোন দিক থেকেই এই বিপ্লবী জীবনের প্রয়োজন তাঁর ব্যক্তিজীবনে ছিল না। ছিলেন প্রুশিয়ার (তৎকালীন জার্মানি) র সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাইন প্রদেশে অভিজাত পরিবারের অনেক কারখানার মালিক ধনী পিতা ফ্রেডরিক সিনিয়রের জ্যেষ্ঠ সন্তান। পিতার আদেশে বাধ্য হয়েছেন পারিবারিক শিল্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে । সেকাজ করতে গিয়ে ইংল্যান্ডে শ্রমিক দুর্দশার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন অনবদ্য “কন্ডিশন অফ ওয়ার্কিঙ ক্লাস ইন ইংল্যাণ্ড “। মার্কসের বিশেষত “জার্মান ইডিওলজি”তেও এঙ্গেলসের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। মূলত নারীসমস্যাকে ভিত্তি করে তিনি লেখেন, “পরিবার, ব্যক্তিমালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”। তিনি ব্যাখ্যা করেন কিভাবে ব্যক্তিসম্পত্তি ব্যবস্হা গড়ে ওঠার পর নারী তার স্বাধীনতা হারায় পুরুষদের কাছে।‌ খামখেয়ালী আমলাগিরি ও স্বেচ্ছাচারিতাকে তিনি ঘৃণা করতেন , শিল্প-পরিচালনা করতে গিয়ে এনিয়ে পিতার সঙ্গে তার মতবিরোধও হয়। অবসরের পর তিনি পূর্ণ সময় আত্মনিয়োগ করেন শ্রমজীবী মানুষের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অভিমুখী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে । বিশেষত শ্রমিকশ্রেণী ও শিক্ষিত মানুষের ব্যক্তি ও সমাজচেতনায় বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে তাঁর অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ ছিল। এঙ্গেলস তাঁর মা’ ফ্রনসিজকা মরিশিয়া ভনের স্বচ্ছচিন্তা ও স্বাধীনচিত্ততার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরিবারে এঙ্গেলসকে বলা হত ‘হংসকুলে কলঙ্ক’ -তারা ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারেননি,অথবা চেষ্টাও করেননি যে, পরিবারের এই সদস্যটিই পৃথিবীর ইতিহাস-সরোবরে এক রাজহংস হয়ে উঠবে -যাঁকে স্মরণ করবে দুনিয়া জুড়ে আগামী প্রজন্মের পর প্রজন্ম । কারণ , এঙ্গেলসের কথায় , “সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনই আগামী সভ্যতার নিয়ন্তা”‘।

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস আজ দু’শো বছর পেরিয়ে এলেন। শ্রদ্ধা-গভীরতম শ্রদ্ধা। বিনম্র অভিবাদন ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।