রাজ্য

প্রতিবন্ধীদের দাবি: লাগু করতে হবে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন ‘১৬


চিন্তন নিউজ, সিউড়ি, ১১ই এপ্রিল— আদৌ কি তারা ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন’? খাতায় কলমে হয়ত তাদের জন্য বরাদ্দ এই তকমাটি। কিন্তু জীবন যুদ্ধে অসীম বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের অদম্য লড়াই-ই জানান দেয় তারা বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন—ই।
উদাহরন বীরভূমের মুনিগ্রামের বছর বত্রিশের সেখ কুরবান। জন্ম থেকেই নেই কোমরের নীচের অংশটি। শারিরীক প্রতিবন্ধকতা কতটা নিশ্চিতভাবেই আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আর পাঁচজনের মতই সংসারি সে। কারন তার আছে হার না মানা জেদ। অভাবী, অনটনে জেরবার। তবু কারো কাছে হাত পাতার ঘোর বিরোধী সে। শুনলে স্তম্ভিত হতে হয়, কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত হীন একটি শরীর নিয়ে এই যুবক দিনগুজরান করেন টোটো চালিয়ে!। যুবকের কথায়, ‘‘জন্ম থেকেই তো কষ্ট করছি। আরও কষ্ট করতে রাজি আছি। দয়া নয়, চাই হক। হকের জন্য লড়াই করছি। করে যাব।’’
টোটো চালাতে হাতও লাগে, পা-ও লাগে। ব্রেক যে থাকে পায়ে। কিন্তু এই যুবকের পা-ই তো নেই। অগত্যা নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে ব্রেকের লিভারকে হাতল দিয়ে লম্বা করে হাতের কাছে তুলে নিয়েছেন। সিটে বসে হাতেই করে ব্রেক কষতে পারেন। দিনের আলো ফুটতে সেই টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রুটির রুজির তাগিদে। ফুটোফাটা একচিলতে ঘর। আশঙ্কা, যেকোনো সময় পড়তে পারে ভেঙে। একটা ঘরের খুব দরকার। হত্যে হয়েও এখনও মেলেনি, তীব্র ক্ষোভ এই যুবকের। তাই তো প্রতিবন্ধীদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন হলেই যুবক থাকেন সামনেই। যুবকের কথায়, ‘‘আইন হয়েছে। দয়া দাক্ষিন্যে নয়, ঘর পাওয়া আমার হক। হক আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। যেমনটা করেছি গত ১৮ই মার্চ। সিউড়িতে জেলাশাসকের দপ্তরে পুলিসের সাথে যুদ্ধ করে ডেপুটেশন দিয়েছি। আরও লড়াই করব।’’ নলহাটির মাঠকলিঠা গ্রামের আমিনা খাতুন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। দুটো পা-ই অকেজো জন্ম থেকে। তারই বন্ধু কয়থা গ্রামের রেবিনা খাতুনেরও নেই ডান পা। সে পা হারিয়েছে লরির ধাক্কায়। ক্রাচে ভর দিয়ে চরম কষ্টের মধ্যে তাদের দিনগুজরান। প্রত্যেকেই হতদরিদ্র দিনমজুর পরিবারের সদস্য। পড়াশুনা করেন। প্রতিবন্ধী ক্রীড়ায় নিয়মিত সদস্য। বড় হয়েছেন, পরিবারকে সাহায্য করার দায়িত্ব কাঁধে চেপেছে। মানবিক ভাতা হাজার টাকায় আর কতটা টানা যায় ? রেবিনা, আমিনার কথায়, ‘‘আমাদের তো সবাই দয়ার চোখে দেখে। কিন্তু কেন আমরা দয়ার পাত্র হব? আমরা আমাদের হক চাই আইন মেনেই। সাহায্য বলতে কোনো এককালে মিলেছিল একটি ট্রাই সাইকেল। কিন্তু তা বহন করা তো আর এক হ্যাপা। রাস্তা ঘাটে খারাপ হলে কি বিপাকে পড়তে হয় আমরা জানি। ক্রাচ নিয়ে প্রতিদিনের যাতায়াতে আর পেরে উঠি না। কেন আমাদের জন্য বরাদ্দ হবে স্বয়ংচালিত ট্রাই সাইকেল? কেন মিলবে না অন্যান্য সহায়তা?’’
বীরভূম জেলাতেই ছড়িয়ে রয়েছে এক লাখেরও বেশী এমন নানান শারিরীক অক্ষমতায় ভোগা মানুষ। ভোটার লিস্টে নামও উঠেছে বিশ হাজারের মত। ভোটের দিন তাদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য কত কিই না সুবিধা প্রদানের ঘোষনা করেছে সরকার। কিন্তু বাকি ৩৬৪টা দিনের কি হবে ? প্রশ্ন অদম্য জেদকে হাতিয়ার করে প্রতিটা দিন চরম প্রতিবন্ধকতার সাথে যুঝে দিনগুজরান করা এই সকল ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন’ মানুষের।
পাশ হওয়া প্রতিবন্ধী অধিকার আইনে রয়েছে, চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষন থাকবে পাঁচ শতাংশ। প্রত্যেকে পাবেন অতিরিক্ত পঁচিশ শতাংশ টাকা বরাদ্দ সহ আবাস যোজনার ঘর। একশো দিনের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকের মধ্যে পাঁচ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। কিন্তু পশ্চিবঙ্গ সরকার নানা ছুতোয় এখনও এরাজ্যে লাগু করে নি এই আইন। তাই তো আমিনা, কুরবান, রেবিনা চালিয়ে যাচ্ছেন নাছোড় লড়াই- রাজ্যে অবিলম্বে লাগু করতে হবে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন’১৬।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।