কলমের খোঁচা

বিপ্লবী মহানায়ক রাসবিহারী বসু


প্রতিবেদনে কল্পনা গুপ্ত, চিন্তন নিউজ,২৫ মে ২০২১– ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ শে মে হুগলি জেলার ভদ্রেশ্বর থানার অন্তর্গত বিঘাটি অঞ্চলের পালারা গ্রামে রাসবিহারী বসু জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ১৩৫ তম জন্মদিনে চিন্তনের পক্ষ থেকে জানাই তাঁর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। সশস্ত্র বিপ্লবের এই উজ্জ্বলতম নক্ষত্রকে বাঙালি কিন্তু সেভাবে মনে রাখেনি। তাঁর আজীবন বৈপ্লবিক কার্যকলাপের কতটুকুই বা চর্চা হয়েছে। রাসবিহারী বসুর জীবনের দুটি সুস্পষ্ট অধ্যায়- একটি হ’ল স্বদেশে তাঁর জাতীয় স্তরের কার্যকলাপ, দ্বিতীয়টি হ’ল জাপান থেকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ।

তাঁর পিতা বিনোদবিহারী বসু ও মাতা ভুবনেশ্বরী বসু। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। বিনোদবিহারী বসু ১৮৯০ সালে বর্ধমানের রায়না থানার সুবলদহ গ্রামের বাস ত্যাগ করে চন্দননগরের ফটকগোড়া অঞ্চলে একটি বাড়ি কেনেন। এখানেই রাসবিহারী বসু ও তাঁর খুড়তুতো ভাই শ্রীশচন্দ্র ঘোষ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। রাসবিহারী বসু জীবনের প্রথমে দেরাদুনের অরণ্য গবেষণাগারে প্রধান করণিকের কাজে নিযুক্ত হন। বিপ্লবের পীঠস্থান কলকাতা ও চন্দননগর থেকে সরে আসতে হ’লেও তিনি বৈপ্লবিক কাজের সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, বারানসী ইত্যাদি জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় স্তরে এক সর্বাত্মক বিপ্লব ঘটানোর জন্য ছদ্মনামে , ছদ্মবেশে কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি বহু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। রাজকর্মচারী হওয়ার সুবাদে ব্রিটিশ সরকারের সন্দেহভাজন তালিকায় প্রথমে না থাকলেও পরে রাজদ্রোহ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পাওয়া যায় যে রাসবিহারী বসুই দিল্লি ষড়যন্ত্রের নায়ক। দীননাথ, অবোধবিহারি, বসন্ত কুমার প্রমুখ বিপ্লবীদের বোমা ছোঁড়া ও রাজদ্রোহমূলক পুস্তিকাদি প্রচার করতে উদ্বুদ্ধ করতেন, শেখাতেন তিনি। রিপোর্টে আরো পাওয়া যায়, ১৯১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তদানিন্তন বড়লাট হার্ডিঞ্জের উপর দিল্লিতে যে বোমা ছোঁড়া হয়েছিল তাতে বসু’র হাত ছিল। বেনারসেও আন্দোলনের ভার গ্রহন করেছিলেন এই অগ্নি পুরুষ। ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারনে তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তাঁর কার্যকলাপের সাথে চন্দননগরের বিপ্লবী, বিশেষত মতিলাল রায়ের সর্বদা যোগাযোগ ছিল। তখন প্রবর্ত্তক সংঘ ছিল বিপ্লবীদের আখড়া। বোমা তৈরির আতুরঘর।

১৯১৫ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় অভ্যুত্থানের দিন স্থির হয়েছিল, কিন্তু কুখ্যাত মাইকেল ও ডায়ারের অধীনে পাঞ্জাবের সরকার ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে বহু বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। সেসময়ে রাসবিহারী বসু পালিয়ে যেতে পারলেও গনেশ পিংলে ধরা পড়েন এবং তাঁর ফাঁসি হয়। ওই বছরই ১২ ই মে রাসবিহারী জাপানি জাহাজ সানুকি মারুতে করে পি এন টেগোর ছদ্মনামে ৫ ই জুন জাপানের জোবে বন্দরে পৌঁছান নিঃসম্বল অবস্থায়।

এরপর তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়। প্রথমে টোকিও শহরে উপস্থিত হন। সামান্য সময় নষ্ট না করে আগ্নেয়াস্ত্র কেনার জন্য সাংহাই পৌঁছান। তাঁর সাথে স্বাধীন চিনের জনক সান ইয়াৎ সানের পরিচয় ঘটে। জাপানেও তাঁকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল, কারণ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ধরিয়ে দেবার পরোয়ানা জারি করেছিল। কিন্তু ব্ল্যাক ড্রাগনের নেতা ও বিখ্যাত বিপ্লবী মিৎসুই তোয়ামার প্রভাবের ফলে জাপান সরকার তাঁকে রক্ষা করতে সম্মত হয়েছিল। ১৯১৮ সালে আজিও সোমার কন্যা তোশিকো রাসবিহারীকে বাঁচানোর জন্য তাঁকে বিয়ে করেন। তোশিকোর অবদান রাসবিহারীর জীবনে গভীর। ১৯২৩ সালে তিনি জাপানের নাগরিকত্ব পান। কিন্তু ১৯২৪ সালের ৪ ঠা মার্চ তোশিকো অর্থাভাবে, খাদ্যাভাবে, রোগজীর্ণ অবস্থায় মারা যান। রাসবিহারী বসু তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

তিনি জাপান এবং পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয়দের নিয়ে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট লিগ গঠন করেন। বহু চড়াই উৎরাই পথে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ৫ ই জুলাই সিঙ্গাপুরের মিটিংএ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট লিগের সভাপতিরূপে এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের মুখ্য কমান্ডার পদাধিকারী রূপে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করেন। ৬ ই জুলাই সুভাষ বসু এই দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৪৪ এর ১৮ ই মার্চ আজাদ হিন্দ ফৌজ সৈন্যরা বার্মা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।

১৯৪৫ সালের ২১ শে জানুয়ারি রাসবিহারী বসুর মৃত্যু হয়। জাপান সম্রাট রাজপরিবারের শবযান পাঠিয়েছিলেন তাঁর দেহ বহন করার জন্য। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বোচ্চ উপদেষ্টার প্রতি শোক প্রদর্শনের জন্য জাপানের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
নিজের স্বাধীন দেশে , স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু কিন্তু অবহেলিতই থেকে গেলেন ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।