রাজ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

পকেটের টাকা দিয়ে প্রতিদিন ছাত্রীদের মিড ডে মিল খাওয়ান কলেজের অধ্যাপিকারা


মাধবী ঘোষ, চিন্তন নিউজ, ১১জুন: স্কুলে পড়ার সময় সরকারের দেওয়া মিড ডে মিল খেয়ে এক বেলা পেট ভরত । কিন্তু কলেজে তো সে ব্যবস্থা নেই। তাই দুঃস্থ পরিবারের পড়ুয়াদের অনেককে খিদে নিয়ে ক্লাস করতে হয় দিনভর। রাজ্যের সর্বত্র এমনই রেওয়াজ। কিন্তু বেহালার একটি কলেজে কার্যত উলট পুরাণ। এখানে শিক্ষিকাদের একাংশ নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রীদের জন্য ডাল ভাত তরকারি ডিম মাংসের মিড ডে মিল এর ব্যবস্থা করেন। বছরভর তাদের উদ্যোগে পেট ভরে খায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পড়তে আসা মেয়ের দল।
বেহালা চৌরাস্তার কাছে ডায়মন্ড হারবার রোডের একদম উপরে বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেন। কলেজ সূত্রে খবর, মিড ডে মিল দেওয়ার উদ্যোগ প্রথমে নিয়েছিলেন অধ্যক্ষা সোমা ভট্টাচার্য্য। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ২০১৬ সাল থেকে প্রতিদিন কলেজে এক ঝাঁক দুঃস্থ পড়ুয়ার মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করতেন। এর জন্য যে অর্থ খরচ হতো তার সম্পূর্ণটাই নিজের পকেট থেকেই দিতে অধ্যক্ষা। বেশ কয়েক বছর এমন চলার পর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি অন্য শিক্ষিকাদের এই কাজে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। অধ্যক্ষার ডাকে সাড়া দেন আরো সাত অধ্যাপিকা। স্থির হয় প্রতি মাসে এই আট অধ্যাপিকা মিড ডে মিলের তহবিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেবেন। সেই ব্যবস্থাই এখন বহাল রয়েছে।
কলেজের নিজস্ব ক্যান্টিন রয়েছে। কিন্তু শিক্ষিকাদের এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ পৃথক। স্বপ্না রায়, রিতা জোয়ারদার, জয়তী ভট্টাচার্য জানালেন স্কুলের তহবিল বা পরিকাঠামোর সঙ্গে মিড ডে মিল এর কোন সম্পর্ক নেই। রিতার কথায়, “এই উদ্যোগটি আমাদের নিজস্ব। তাই যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আমরা নিজেরাই করে চলেছি। কেবল টাকাপয়সার বিষয় তো নয়, রান্নার সরঞ্জাম এর ব্যবস্থা করা রাধুনী ঠিক করা , গ্যাস শেষ হয়ে গেলে ফের গ্যাস আনা সবকিছুই আমরা হাতে হাত মিলিয়ে করি।” জয়তি বলেন, “বার্ষিক এক লক্ষ টাকার কম আয়ের পরিবার থেকে যে মেয়েরা আসে আমরা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। ছাত্রীরা প্রথমে কাগজে লিখে মিড ডে মিল এর জন্য আবেদন করে। সেই আবেদনের ভিত্তিতেই ওদের নির্দিষ্ট কুপন দেয়া হয়। ওই কুপন দেখিয়ে মেয়েরা খাবার সংগ্রহ করে।”
কি খাওয়ানো হয় মিড ডে মিলে? মিঠু সিংহ, সুমনা দাস, তমশা চট্টোপাধ্যায় এর অধ্যাপিকা জানালেন, তারা চেষ্টা করেন প্রোটিন জাতীয় খাবারের ব্যবস্থা করতে। তাই ডাল ভাতের সঙ্গে সয়াবিন বেশি দেয়া হয় তবে মাঝেমধ্যে মাংসের ব্যবস্থা করেন তাঁরা । তমশা বলেন, কলেজের একটি অব্যবহৃত ঘরকে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়েছে। সেখানেই রান্না হয়।
বেহালায় এই কলেজে স্থানীয় মেয়েরা যেমন ভর্তি হন, তেমনই বিপুল সংখ্যক ছাত্রী আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার দূর-দূরান্ত থেকে। অধ্যক্ষের কথায়, “কেউ ডায়মন্ড হারবার থেকে আসে, কেউ আসে ফলতা থেকে। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় ওদের। আর্থিক সংকট তো আছেই, পাশাপাশি দূরত্বটা অনেক। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা দিনভর না খেয়ে থাকবে নাকি! তাই সীমিত সামর্থ্যে আমাদের এই উদ্যোগ।”
রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই মিড ডে মিল নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। এই কলেজের ছবিটা অবশ্য একদমই আলাদা। এক শিক্ষিকার কথায়, “ওরা তো আমাদের মেয়ের মত। তাই সাধ্য মত যতোটুকু ভাল চাল ভাল তেল পারি তাই দিয়েই রান্না হয়।”
শিক্ষিকাদের এমন প্রচেষ্টায় মুগ্ধ শিক্ষা মহলের একাংশ। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় এর মন্তব্য, “এরাই প্রকৃত শিক্ষিকা। এমন মানুষ আছেন বলেই এমন শিক্ষা ব্যবস্থা টিকে আছে।”


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।