রাজ্য

হাওড়া জেলাঃ অতীত ও বর্তমান


সৌমদ্যুতি ভৌমিক:চিন্তন নিউজ:১৩ই মার্চ:–‘সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ কবির কাব্যিক ভাবনায় ভাবিত না হয়েও বলা যেতে পারে যে যেখানে থাকেন সেই শহরকে সকলের বাসযোগ্য করে তোলার দায় দায়িত্ব ও অধিকার তাদের সকল অধিবাসীবৃন্দের ।

ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পর থেকেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিবার্চনের মাধ্যমেই প্রশাসনিক দায়িত্ব বন্টন হয়ে থাকে । তবে অবশ্য এই হাওড়া শহরের ইতিহাস বহু প্রাচীনতায় পরিপূর্ণ । প্রায় পাঁচ শত বছরের ইতিহাসের প্রবাহমানতা বয়ে চলেছে এই শহরের আকাশে বাতাসে প্রতিটি ধূলিকনার মধ্যে দিয়ে । তাই প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, প্রথম থেকেই খুব যে পরিকল্পিত ভাবে এই শহরটি গড়ে উঠেছে তা নয়, বরং বেশ কিছুটা অবহেলা এবং পরিকল্পনাহীনতার প্রকট প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান । যদিও পরাধীন ভারতবর্ষের বুকেই ১৮৫৮ সালে হাওড়া পৌরসভা তৈরী হয় তৎকালীন জেলাশাসক ও হাওড়ার প্রথম চেয়ারম্যান মিঃ ই সি ক্রাস্টার এর তত্ত্বাবধানে । সেই সময় বালি এবং হাওড়া একই পুরসভার অন্তর্গত ছিলো । পরবর্তী সময় ১৮৮২-৮৩ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে বালি পুরসভাকে আলাদা করা হয় । ১৮৮৬ সালে বাবু কেদারনাথ ভট্টাচার্য্য প্রথম নির্বাচিত ভারতীয় চেয়ারম্যান হন ।

প্রথম অবস্থা থেকে নাগরিকবৃন্দ দ্বারা নির্বাচিত সদস্যদের মাধ্যমে হাওড়া পুরসভার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা হতো । স্বাধীনতার পরবর্তী সময় কংগ্রেস দ্বারা হাওড়া পুরসভা পরিচালিত হতো এবং ১৯৭২ সালে এই পুরসভা সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়ে । ১৯৭৭ সালে গোটা রাজ্যে বামফ্রন্ট শাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর প্রথমে হাওড়ায় মনোনীত বোর্ড তৈরী হয় এবং ১৯৮০ সালে প্রথম হাওড়া পুরনিগম গঠিত হয় । ১৯৮৪ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত বোর্ড গঠিত হয় যার প্রথম মেয়র হন কমঃ অলোকদূত দাস ।

ইতিহাসের এই প্রসঙ্গটা আসার প্রয়োজন হলো কারণ, বর্তমানকে বিশ্লেষন করতে গেলে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা ভালো করে জেনে নেওয়া প্রয়োজন । ১৯৮৪ সালের আগে পর্যন্ত হাওড়া শহর কেমন ছিলো এবং পরবর্তী প্রায় ৩৬ বছরে কতটা পরিবর্তিত হতে পেরেছিলো এই শহর তার একটা আশু বিশ্লেষণের প্রয়োজন । হুগলী নদী এবং রেলপথের কারণে হাওড়া বহুদিন পূর্বেই এক বাণিজ্যনগরীতে পরিণত হয়েছিলো । যদিও সেই প্রাচুর্য এখন ক্ষয়িষ্ণু । তবুও আলোচনার প্রয়োজনে কিছু প্রসঙ্গের উত্থাপন করা প্রাসঙ্গিক ।

হুগলীনদীর পার্শ্ববর্তী হলেও হাওড়া শহরের প্রধান সমস্যা বলতে জলের অপ্রাচুর্য । বহুদিন ধরেই পরিশুদ্ধ পানীয়জল বলতে গভীর নলকূপের ব্যবস্থায় হাওড়াবাসী প্রধান ভরসা ছিলো । যদিও কিছু হ্যান্ড পাম্পের ব্যবস্থাও করা হয়েছিলো কিন্তু তা কখনই জলের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান করতে পারেনি । হাওড়ার এই অঞ্চলে রাস্তা বলতে প্রধানত ইতিহাস প্রসিদ্ধ জি. টি. রোড । এছাড়া স্থানীয় আঞ্চলিক কিছু রাস্তা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তার অস্তিত্ব ছিলো না । দূর্বল নিকাশী ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত জনবসতি, প্রয়ঃপ্রনালীর অভাব ও পুরাতন খাটা পায়খানা ব্যবস্থা ক্রমশঃ এই শহরকে দূষিত শহরের পরিণত করেছিলো ।

১৯৮৪ সালে মাত্র ১০টা ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বামফ্রন্ট পরিচালিত হাওড়া পুরনিগম ক্রমশঃ বর্ধিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ৫০টি ওয়ার্ডের প্রশাসনিক শহরে পরিণত করা হয় । প্রথমেই ৪০ এম জি পদ্মপুকুর জল প্রকল্পের মাধ্যমে বর্ধিত এলাকা বাদে প্রায় সর্বত্র ট্যাপ ওয়াটারের ব্যবস্থা করা হয় । সাথে সাথে হাওড়া অঞ্চলকে ক্রমপর্যায়ে বিভিন্ন রোড, লেন এবং বাই লেনের সংস্কারের মাধ্যমে পাকা অর্থাৎ পিচ এবং কংক্রিটের রাস্তায় পরিণত করা হয় । নিকাশী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক অবস্থান অনুসারে নদীর দিকে ঢাল থাকা স্বত্ত্বেও তৎকালীন বি.ই কলেজ এবং বি. গার্ডেনের অবস্থান প্রধান অসুবিধা সৃষ্টি করলেও পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হয় বামপন্থী পুরনিগম । দূষণমক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও প্রয়ঃপ্রনালী সংস্কার ও পুরানত খাটা পায়খানা তুলে দিয়ে আধুনিক ব্যবস্থাকে প্রণয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয় । সি. এম. ডি. এ, পুরনিগম এবং সরকারের প্রচেষ্ঠায় বর্ধিত অঞ্চল ব্যতীত প্রায় সব জায়গায় সেই আধুনিকতার ছোঁয়াচ লাগে । পরিছন্নতার প্রয়োজনে দিনে দুবার সাফাই ব্যবস্থাও প্রচলিত হয় বাম জমানায় । বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রেও বলতে হচ্ছে বর্ধিত অঞ্চলের কিছু অংশ ছাড়া প্রায় সর্বত্র ঘরে ঘরে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে এবং পথঘাটে আলো পৌঁছায়নি এমন জায়গা সত্যই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় । এছাড়াও বিভিন্ন পার্ক, স্টেডিয়াম, শরৎসদন থেকে শুরু করে নিত্যদিনের যাতায়াত ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ বিগত বামফ্রন্ট পরিচালিত বোর্ড করে গিয়েছে ।

যদিও একথা কখনই অস্বীকার করা যায় না যে, সকলের সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা এবং সকল প্রকার উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিগত সরকার সম্পূর্ন সফল হয়েছে । শহর বেড়েছে । সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে জনবসতি । মানুষের প্রতিনিয়ত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রচেষ্টা করলেও সর্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা গড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি ।

এবার আসা যাক, বর্তমানে কেমন আছে আমাদের প্রিয় শহর ? কতটা সুস্থ স্বাভাবিক এবং নিরাপদ আমাদের জনজীবন ? নির্বাচনের পর গঙ্গার জল দিয়ে পুরসভার দপ্তর ধুয়ে যে প্রাথমিক চমক তৈরী করা হয়েছিলো তার পরিণতি কি হলো ? বাম সরকার নির্মিত পুরানো দেওয়ালে নতুন নীলসাদা রঙ, পুরাতন আলোক স্তম্ভের নীচে ত্রিফলা, ডাস্টবিনের দরজা আর অনুপ্রেরণার ফলক ছাড়া হাওড়ার মানচিত্রে নতুন সংযোজনের তালিকা পাওয়া সত্যিই দুষ্কর । কিছু জায়গায় অবশ্যই পানীয় জলের আধার বসেছে । আর এই সামান্য সংস্কারের ফলে যে দুর্নীতির আবির্ভাব হয়েছে তার ফলস্বরূপ হাওড়া পুরনিগমের নির্বাচন ব্যবস্থাটাই উঠে যাওয়ার মুখে অবনত হয়েছিলো । অর্থনীতির সম্পর্কে যাঁরা সামান্য জানেন তাঁরা এটা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, নামের ফলক বসিয়ে সার্বিক উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয় । কেবল উদ্বোধন নয় সঠিক সময় সংস্কার না করতে পারলে যেকোনো ব্যবস্থাই তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙে পড়ে । যারা হাওড়ার এই অঞ্চলে থাকেন এবং অঞ্চলটিকে ভালোবাসেন তারা প্রতিদিনের অব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্বিসহ যন্ত্রণা রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করতে পারছেন । বিভিন্ন ওয়ার্ডের বহু জায়গার নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে । অনেক জায়গা দেখলে মনে হয় আকাশে মেঘ দেখলেই বোধহয় রাস্তায় জল জমে যায় । আন্দুল রোডের যানজটে ভুক্তভোগী নন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব । অবাস্তব হলেও যদি ধরেও নি এই পৃথিবীর কেউ সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আছেন, তবে প্রতিটি এলাকায় সাফাই কর্মীদের রোজ দেখতে পাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখার বিলাসিতা তিনিও করতেন না । পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের উদাহরণ স্বরূপ প্রায়শঃই দেখতে পাওয়া যায় যে কোনো গৃহীত পরিকল্পনার ক্ষেত্রেই আজ কোনো কাজ গড়া সমাপ্ত হলো তো আগামী কাল থেকে আবার সেটা ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেল । আসলে সার্বিক উন্নয়নের চেয়ে যখন নির্মান ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের সুযোগ প্রাধান্য পায় তখন নাগরিকবৃন্দের সুবিধা দেখার প্রয়োজনটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ।
ফলতঃ পাহাড় প্রমান দুর্নীতির ভয়াবহ চাপ এমন পর্যায় গিয়েছে যে পাঁচ বছরে একবারও অডিট করে তার প্রতিবেদন জনসমক্ষে আনার সাহস পায়নি । নাগরিকবৃন্দের সুযোগ সুবিধার প্রসঙ্গ যখন উত্থাপন হল, তখন প্রথমেই বলতে হয় বিগত বামফ্রন্ট পুরনিগম যেসকল সুব্যবস্থা প্রনয়ন করেছিলো যেমন, বি.পি.এল তালিকা তৈরী করে এবং প্রতি নিয়ত সংশোধন করে রেশন ব্যবস্থাকে জনমুখী করে তোলা তা বর্তমানে অব্যবস্থায় পরিপূর্ণ । বিশেষত ডিজিটাল রেশন কার্ড প্রদানের চুড়ান্ত ব্যর্থতায় প্রায় সকলেই তার স্বকীয়তা হারিয়েছে । একই অবস্থা বিধবাভাতা, বার্ধক্যভাতা প্রভৃতির ক্ষেত্রেও । পূর্বের তৈরীর ওয়ার্ড কমিটি, নাগরিক কমিটিকে নিয়ে কাজ করার যে সুব্যবস্থা প্রনয়ন হয়েছিল তাও ধ্বংসের মুখে । এক চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং সর্বব্যাপী নৈরাজ্য ও দুর্নীতির এই পুরনিগম প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে নিজেদের দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করার সঙ্গে সঙ্গে হাওড়ার সমস্ত নাগরিকবৃন্দকে নেই রাজ্যের বাসিন্দাতে পরিণত করেছে ।

এই চূড়ান্ত অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এখুনি রুখে না দাঁড়ালে সমস্ত হাওড়াবাসী, ভারতীয় সংবিধানে প্রণোদিত সকল নাগরিক অধিকার থেকে শুধু বঞ্চিতই হবেন না, এই আপাদমস্তক ধড়িবাজদের সকল দুর্নীতির ভয়াবহ শিকারে পরিণত হবেন ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।