মৌসুমী চক্রবর্তী: চিন্তন নিউজ:২৯শে অক্টোবর:–এক জনের কণ্ঠে ছিলো গান। অন্য জনের হাতে ‘গান’।
এই হাতিয়ার নিয়েই একজনের অবর্তমানে আরেক জনের এগিয়ে চলা সম্পদ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে ।
১৯৭৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর খুন হন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা, যিনি ছিলেন শিক্ষক ও গায়ক #হারা, যে সময়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আউগুস্তো পিনোশের বাহিনী যখন চিলির ক্ষমতা দখল নিচ্ছে। হারা-হত্যার ভয়ঙ্কর কষ্টের স্মৃতি নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তাঁর স্ত্রী জোন। আর এই জোনের অনেক অনেক অবদান বাংলা গণনাট্য সঙ্ঘের ।তাঁর জন্যই বাংলা গণনাট্য সংঘ সৃষ্টি করতে পেরেছিল ‘খোলা জানালার গান’।
হারা গান বাঁধতেন, সুর করতেন, গাইতেন।জীবনের গান বাঁচতে অনেক লড়াই তাঁকে করতে হয়েছিল ।ভায়োলেটা পেরার কাছেই লোকগানে নিজের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন।
হারা বেশ কিছু দায়িত্ব পেয়েছিলেন চিলিতে সালভাদর আইয়েন্দে তাঁর বামপন্থী সরকারে । পিনোশে বাহিনী আইয়েন্দের সরকারকে ফেলে ক্ষমতা দখলের সময় থেকেই মরিয়া হয়ে খুঁজছিল হারাকে। চিলি সেটডিয়ামে হাজার পাঁচেক মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়,যার মধ্যে হারাও ছিলেন । হারাকে চিনে ফেলে বাহিনীর জওয়ানেরা, তাঁকে তারা স্টেডিয়ামের ভিতরে একটি চেয়ারে বসতে দেয় । টেবিলটিতে রাখা ছিল তাঁর প্রিয় গিটার। নৃশংস ভাবে বন্দুকের বাঁট দিয়ে প্রথমে থেঁতলে দেওয়া হয় হারার হাতের আঙুল। তার পরে বারবার আদেশ দিতে থাকে হারার গান গাইবার জন্য ।
কিন্তু হারা কাপুরুষদের কাছে মাথা নত করেননি ।অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এবং শুরু করেছিলেন তাঁদের তৎকালীন পার্টির জন্য লেখা গান। স্টেডিয়ামে আটক পাঁচ হাজার কণ্ঠ যোগ দেয় সেই গানে।পিনোশে বাহিনী প্রমাদ গোনে এবং তার পরে আচমকাই গুলির শব্দ। ছেচল্লিশটা গুলি, হ্যাঁ স্বৈরাচারী শাসকের ছেচল্লিশ টা বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল হারার দেহ।
একটি প্রতিবাদীকে ,সাংস্কৃতি যাঁর হাতিয়ার তাঁকে খতম করলো,প্রতিবাদকে খতম করতে পেরেছে কি জহ্লাদ বাহিনী !!এখনও এই প্রশ্ন ভেসে বেড়ায় ।পরিশেষে জহ্লাদ বাহিনী এক গণ কবরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তাঁর ক্ষত-বিক্ষত দেহ।
কিন্তু হারার গান রয়ে গেল।এলো এদেশে,বাংলায়।
ভারতীয় গণনাট্যসংঘ পশ্চিমবঙ্গের সংগীত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কঙ্কন ভট্টাচার্য স্মৃতিচারণায় জানান — ‘‘ওঁর সব গান পিনোশের লোকজন নষ্ট করে ফেলত। কোনও ভাবে পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে হারার স্ত্রী জোন ও কয়েক জন কিছু রেকর্ড সঙ্গে নিয়ে পালাতে পেরেছিলেন। জোন আদতে ব্রিটিশ। ইংরেজি অনুবাদ করে তিনিই হারার গান ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর পাঠানো গান থেকেই পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্য সংঘ ‘খোলা জানালার গান’ অ্যালবাম করতে পেরেছিল।
জোন এখন ব্রিটেন এবং আমেরিকায় ঘুরে-ফিরে থাকেন। জোন ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল কঙ্কনবাবুর। পরে ক্যাসেটও পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। হারার সঙ্গে কঙ্কন বাবু ভারতের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তুলনা করেছেন । “অপূর্ব গলা। গণসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত যেমন গাইতেন, তেমনই আধুনিক রোমান্টিক গানেও সমান স্বচ্ছন্দ।’’
এখন যে গান ‘রাইট টু লিভ ইন পিস’চিলির পথে পথে শোনা যাচ্ছে, সেই গান হারা লিখেছিলেন ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের জন্য। যেখানকার যে আন্দোলনের জন্যই কলম ও গিটার ধরেছেন হারা, সেখান থেকেই আবার বাংলায় অনূদিত হয়ে এসেছে গান প্রতিবাদে শান দিতে। প্রতিবাদের সুর কবে আর দেশ-কাল-ভাষার গণ্ডি মেনেছে!
এক জনের কণ্ঠে ছিলো গান। অন্য জনের হাতে ‘গান’। এই হাতিয়ার নিয়েই একজনের অবর্তমানে আরেক জনের এগিয়ে চলা সম্পদ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে ।
দু’দিকের শব্দই থেমে গিয়েছে কয়েক দশক আগে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের গলায় প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ফিরে এসেছে কিছু গান। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর রাস্তায় লাখ লাখ কণ্ঠে এখন আবার বেঁচে উঠেছেন ভিক্টর হারা। যাঁর রেখে যাওয়া গানের সূত্রে বাঁধা পড়েছিল এই বাংলাও।